নিলামে উঠছে সাবেক এমপিদের আনা ৪৪ বিলাসবহুল গাড়ি
- আপডেট সময় : ০৮:৫৩:১৮ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ১ সেপ্টেম্বর ২০২৪
- / 63
জাপান ও অস্ট্রেলিয়া থেকে আমদানি করা গাড়িগুলো সরবরাহ নেয়ার আগেই সংসদ বিলুপ্ত করায় এখন আর শুল্কমুক্ত সুবিধায় গাড়ি নেয়ার সুযোগ নেই। শুল্ক দিতে গেলে প্রতিটি গাড়ির শুল্ক আসবে আট কোটি টাকার বেশি।
সংসদ সদস্য কোটায় শুল্কমুক্ত সুবিধায় আমদানি করা ৪৪টি বিলাসবহুল গাড়ি আটকে দিয়েছে শুল্ক বিভাগ।
গাড়িগুলো যারা আমদানি করেছিলেন তারা আর সংসদ সদস্য না থাকায় এগুলো আটকে দেয়া হয়েছে। ল্যান্ড ক্রুজার, রেঞ্জ রোভার, টয়োটা জিপ, টয়োটা এলসি স্টেশন, মার্সিডিজ বেঞ্জ ও বিএমডব্লিউ ব্র্যান্ডের এসব গাড়ি নিলামে উঠতে যাচ্ছে।
গাড়িগুলোর প্রতিটির বাজারমূল্য ১০ থেকে ১২ কোটি টাকা। অথচ শুল্কমুক্ত সুবিধার কারণে এসব গাড়ি শুধু আমদানি মূল্যেই (প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ টাকা) এনেছিলেন তারা।
জাপান ও অস্ট্রেলিয়া থেকে আমদানি করা গাড়িগুলো সরবরাহ নেয়ার আগেই সংসদ বিলুপ্ত করায় এখন আর শুল্কমুক্ত সুবিধায় গাড়ি নেয়ার সুযোগ নেই। শুল্ক দিতে গেলে প্রতিটি গাড়ির শুল্ক আসবে আট কোটি টাকার বেশি।
ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মুখে ক্ষমতাচ্যুত হয় আওয়ামী লীগ সরকার। এরপর সংসদ ভেঙে দেয়া হয়। এর আগেই প্রায় ৫১ জন সংসদ সদস্য তাদের জন্য শুল্কমুক্ত সুবিধায় গাড়ি আনেন। চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর দিয়ে এসব গাড়ি গত জুলাই থেকে আসা শুরু হয়।
গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের আগ পর্যন্ত আটজন গাড়ি সরবরাহ নিলেও বাকি এমপিদের গাড়ি দুই বন্দরে আটকা রয়েছে। এমপি পদ না থাকায় তারা এসব গাড়ি শুল্কমুক্ত সুবিধায় নিতে পারবেন না। তবে চাইলে শুল্ক দিয়ে নিতে পারবেন। সে হিসাবে ৫১টি গাড়িতে সরকার শুল্ক পেত প্রায় ৪০০ কোটি টাকা। এখন শুল্ক দিয়ে সরবরাহ না নিলে নিলামে উঠবে এসব গাড়ি।
কাস্টমস সূত্রে জানা গেছে, শুল্কমুক্ত সুবিধায় গাড়িগুলো আমদানি করেছেন সাবেক ডেপুটি স্পিকার শামসুল হক টুকু, সাবেক মন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক ও মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া, সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাত, সাবেক সংসদ সদস্য ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান, চিত্রনায়ক ফেরদৌস আহমেদ, নেত্রকোনার সাবেক সংসদ সদস্য সাজ্জাদুল হাসান, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সাবেক সংসদ সদস্য এসএকে একরামুজ্জামান, ফয়জুর রহমান, সিরাজগঞ্জের চয়ন ইসলাম, জান্নাত আরা হেনরি, নাটোরের আবুল কালাম, সিদ্দিকুর রহমান পাটোয়ারী, বগুড়ার মজিবুর রহমান মঞ্জু, রেজাউল করিম তানসেন, টাঙ্গাইলের অনুপম শাহজাহান জয়, হবিগঞ্জের ব্যারিস্টার সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন, সুনামগঞ্জের রনজিৎ সরকার, ড. সাদিক, গাইবান্ধার আবুল কালাম আজাদ, ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমর (যিনি নির্বাচনের আগে বিএনপি ছেড়ে আওয়ামী লীগে যোগ দেন), যশোরের নওয়াব আলী জোয়ার্দার, ঝিনাইদহের নাসের শাহরিয়ার জাহিদি, লক্ষ্মীপুরের মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী ও দিনাজপুরের মুহাম্মদ জাকারিয়া।
এ ছাড়া গাড়ি আমদানি করেছেন সাবেক এমপি আব্দুল মোতালেব, মোহাম্মদ গোলাম ফারুক, শাহ সরওয়ার কবির, এবিএম আনিসুজ্জামান, সাদ্দাম হোসাইন পাভেল, এসএম আল মামুন, আক্তারুজ্জামান, মো. সাইফুল ইসলাম, এসএম কামাল হোসেন, মাহমুদ হাসান রিপন, মুজিবুর রহমান, এসএম আতাউল হক, মাহমুদুল হক সায়েম, মো. মতিউর রহমান, মো. তৌহিদুজ্জামান, মোহাম্মদ আব্দুল ওয়াহেদ ও সিদ্দিকুল আলম।
এ ছাড়াও সংরক্ষিত আসনের সাবেক সদস্যদের মধ্যে গাড়ি আমদানি করেছেন তারানা হালিম, সানজিদা খানম, নাসিমা জামান ববি, খালেদা বাহার বিউটি, রুনু রেজা ও সাহিদা তারেক দিপ্তি।
এনবিআরের নথি অনুযায়ী, চট্টগ্রাম, মংলা বন্দর ও কমলাপুর আইসিডি থেকে সাতটি গাড়ি ছাড়া হয়েছে। সেগুলো আমদানি করেছেন ক্রিকেটার ও মাগুরা-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য সাকিব আল হাসান, ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৫ আসনের ফয়জুর রহমান, লক্ষ্মীপুর-৩ আসনের গোলাম ফারুক পিংকু, নাটোর-১ আসনের আবুল কালাম, কিশোরগঞ্জ-৫ আসনের মুজিবুর রহমান মঞ্জু এবং সংরক্ষিত নারী আসনের সাবেক এমপি জান্নাত আরা হেনরি। আরেকজন সাবেক সংসদ সদস্যের পরিচয় নিশ্চিত করা হয়নি।
কাস্টমসের নথি বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, গত ১৭ জুলাই সিঙ্গাপুরের টয়োটা স্টোশু এশিয়া প্যাসিফিক পিটিই লিমিটেড থেকে ১ দশমিক ২৭ কোটি টাকা মূল্যের টয়োটা এল সি স্টেশন ওয়াগন জিআর-এস মলেডের একটি গাড়ি আমদানি করেন সাবেক সংসদ সদস্য সাকিব আল হাসান। সাকিব আল হাসানের পক্ষে এ গাড়িটি খালাসের জন্য কাস্টমসে নথি দাখিল করে নাভানা লিমিটেড।
চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে আনা ৩৩৪৬সিসির এ গাড়িটির স্বাভাবিক শুল্ককর হার ৮২৬ দশমিক ৬ শতাংশ।
বন্দরে খালাসের অপেক্ষায় থাকা ৪৪টি গাড়ির মধ্যে মাত্র তিনটি গাড়ির বিপরীতে বিল অফ এন্ট্রি দাখিল হয়েছে। দিনাজপুর-১ আসনের মুহাম্মদ জাকারিয়া, টাঙ্গাইল-৮ আসনের অনুপম শাহজাহান জয়, সংরক্ষিত নারী আসনের সংসদ সদস্য নাসিমা জামান ববির নামে এসব এন্ট্রি দাখিল করা হয়।
তবে চট্টগ্রাম কাস্টমসের কমিশনার মোহাম্মদ ফাইজুর রহমান গণমাধ্যমকে বলেন, জাহাজ থেকে নামার পর এখনও অনেক গাড়ি কার শেডে পৌঁছেনি। তাই গাড়ির সংখ্যা প্রকৃতপক্ষে কত তা এখনই চূড়ান্ত করে বলা যাচ্ছে না।
মূলত গত জুলাই থেকে এমপি সুবিধায় আনা গাড়িগুলো আসতে শুরু করে। অনেকে ডেলিভারি (সরবরাহ) নিয়েছে এবং ৫ আগস্টের পর আমরা কোনো গাড়ি ডেলিভারি দেইনি।
এসব গাড়ির দায়িত্বে থাকা চট্টগ্রাম কাস্টমসের ডেপুটি কমিশনার অনুরূপা দেব বলেন, সবার নাম তো আমাদের মুখস্থ থাকার কথা নয়। তবে যারা তারকা তাদের কয়েকজনের মধ্যে ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান, নায়ক ফেরদৌস ও ব্যারিস্টার সুমনের নাম মনে আছে। আরও অনেকে গাড়ি নিয়ে গেছেন।
বাংলাদেশ রিকন্ডিশন্ড ভেহিক্যালস ইম্পোর্টার্স অ্যান্ড ডিলাস অ্যাসোসিয়েশনের (বারভিডা) সাবেক সাধারণ সম্পাদক হাবিবুর রহমান বলেন, এমপি সুবিধায় আনা এসব গাড়ির আমদানি মূল্য অন্তত ১ লাখ ডলার (১২০ টাকা হিসেবে ১ কোটি ২০ লাখ টাকা)। তার ধারণা প্রায় ৮ কোটি টাকা শুল্ক পরিশোধ করে কেউ এসব গাড়ি সরবরাহ নেবেন না।
তিনি বলেন, নিলামের মতো দীর্ঘ প্রক্রিয়ায় গেলে গাড়িগুলো নষ্ট হয়ে যেতে পারে। তাই এখনই সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের আওতায় ব্যবহার করা গেলে গাড়িগুলো নষ্ট হবে না। এর আগে পর্যটন সুবিধায় (কারনেট সুবিধায়) আনা ১১৯টি গাড়ি নষ্ট হয়েছিল।
চট্টগ্রাম কাস্টমসের কমিশনার ফাইজুর রহমান গণমাধ্যমকে বলেন, কারনেট সুবিধায় আনা গাড়িগুলো পুরাতন ছিল। তাই নির্ধারিত প্রক্রিয়ার পর নিলামে যেতে সময় লেগেছে। কিন্তু এসব গাড়ি নিলামে যেতে তেমন সময় লাগার কথা নয়। এগুলো নতুন গাড়ি।
তিনি বলেন, প্রথমত আমদানিকারক চাইলে বর্তমান শুল্ক পরিশোধ করে গাড়ি ডেলিভারি (সরবরাহ) নিয়ে যেতে পারে।
দ্বিতীয়ত পর্যাপ্ত ডকুমেন্ট সব সাবমিট করে যে টাকায় কেনা হয়েছে, সেই টাকা বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা হওয়ার পর সরকারি আইন অনুযায়ী আমদানিকারক যে দেশ থেকে কিনেছে সেই দেশে ফেরত পাঠাতে পারে।
তৃতীয়ত, এ দুইয়ের কোনোটি না হলে নির্ধারিত সময়ের পর কাস্টমস কর্তৃপক্ষ নিলাম আহ্বান করতে পারে।
তবে বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, এসব গাড়ি নিলাম ছাড়া কোনো উপায় নেই।
কাস্টমসের নিলাম শাখার ডেপুটি কমিশনার সাইদুল ইসলাম বলেন, বিধি অনুযায়ী বন্দরে গাড়ি নামার ৩০ দিন পর আমরা আমদানিকারক বরাবর দুই দফায় দুটি নোটিফিকেশন পাঠাই। নোটিফিকেশন পাঠানোর পর সঠিক জবাব পাওয়া না গেলে সরকারি বিধিবিধান মেনে আমরা নিলাম বিজ্ঞপ্তি দিয়ে থাকি।
নিউজটি শেয়ার করুন