মানুষ বেশিদিন বাঁচলেও আয়ুর সর্বোচ্চ সীমা কত?

- আপডেট সময় : ১১:০৭:৪৫ অপরাহ্ন, সোমবার, ১৪ এপ্রিল ২০২৫
- / 7
মানুষ বেশিদিন বাঁচলেও ঠিক কতদিন তার আয়ুর সর্বোচ্চ সীমা? সম্প্রতি ডাচ গবেষকদের এক গবেষণায় বেরিয়ে এসেছে এক অদ্ভুত তথ্য।
নতুন গবেষণাটির ফল রীতিমতো চমকে দেওয়ার মতো। ৩০ বছরের মধ্যে সংগ্রহ করা প্রায় ৭৫,০০০ মৃত মানুষের রেকর্ডের তথ্য বিশ্লেষণ করে টিলবার্গ এবং ইরাসমাস বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা মানব জীবনের সর্বাধিক সীমা চিহ্নিত করেছেন। আর সেটি হলো-ড় নারীরা যদি দীর্ঘায়ু হন তবে সর্বোচ্চ ১১৫.৭ বছর পর্যন্ত বাঁচেন। পুরুষদের ক্ষেত্রে আয়ুস্কালের সর্বোচ্চ সীমা আরও কম ১১৪.১ বছর।
গবেষণার একজন প্রধান গবেষক অধ্যাপক জন আইনমাহল উল্লেখ করেন, মানুষের জীবনের আয়ু অনেক বাড়লেও সবচেয়ে বয়স্ক মানুষেরা দীর্ঘকাল বেঁচে থাকার অতীতের রেকর্ড ভাঙতে পারেনি।
তিনি বলেন, “যদিও জীবনকাল বাড়ছে, তবে গত তিন দশকে সবচেয়ে বয়স্ক ব্যক্তিরা (আগের বয়স্ক ব্যক্তিদের চেয়ে) আরও বয়স্ক হননি।”
এই ফলাফল একটি অদ্ভুত প্যারাডক্সের জন্ম দিয়েছে। যদি মৃত্যুর গড় বয়স বৃদ্ধি পায়, তবে কেন সবচেয়ে বয়স্ক মানুষগুলো অতীতের সবচেয়ে বেশি আয়ুষ্কালের রেকর্ড ভাঙতে পারছেন না?
আইনমাহলের মতে, সেখানে একটি জৈবিক সীমা থাকতে পারে- “নিশ্চিতভাবেই একটি দেওয়াল আছে।”
তিনি বোঝাতে চাইছেন, স্বাস্থ্যসেবা এবং পুষ্টির ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য উন্নতি সত্ত্বেও মানুষের দীর্ঘায়ুর একটি স্বাভাবিক সীমা থাকতে পারে।
এই গবেষণার ফলাফলগুলো চিকিৎসার অগ্রগতিতে জীবনের সময় বৃদ্ধি করার ধারণাটিকেই চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয়।
‘আয়ুষ্কাল’ এবং ‘প্রত্যাশিত আয়ু’ এর মধ্যে পার্থক্য বুঝতে পারাটা জরুরী। আয়ুষ্কাল ব্যক্তির জীবনের প্রকৃত সময়কাল নির্দেশ করে। আর প্রত্যাশিত আয়ু হলো একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠী বা দেশের মানুষেরা কত বছর বাঁচার আশা করতে পারেন- তার গড় বয়স। ‘প্রত্যাশিত আয়ু’ প্রায়ই একটি সমাজের সামগ্রিক স্বাস্থ্য এবং কল্যাণের পরিমাপ হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
ঠিক গত বছরই যুক্তরাষ্ট্রের বিজ্ঞানীদের একটি গবেষণা থেকেও মানুষের আয়ুষ্কালের সর্বোচ্চ সীমা নিয়ে প্রায় একই রকম ফল এসেছে। দুই গবেষকদলই একটি সম্ভাব্য বয়সের সীমা চিহ্নিত করেছেন। তবে যুক্তরাষ্ট্রের কিছু বিশেষজ্ঞের ভিন্ন মত রয়েছে। তারা মনে করেন, বর্তমানে সবচেয়ে বয়স্ক ব্যক্তিরা তাদের পূর্ববর্তী প্রজন্মের মতো দীর্ঘজীবী হচ্ছেন না।
তবে, আইনমাহলের গবেষণা দল এই ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করে। ‘এক্সট্রিম ভ্যালু থিওরি’ নামে পরিচিত একটি সর্বাধুনিক পরিসংখ্যানগত পদ্ধতি প্রয়োগ করে তারা উপসংহারে পৌঁছেছেন যে- মানুষের সর্বাধিক আয়ুষ্কালের গড় ‘অপ্রত্যাশিতভাবে অপরিবর্তিত’ রয়েছে। প্রচলিত নিয়ম থেকে সাধারণত বিরল এবং চরম ঘটনাগুলো (যেমন দীর্ঘ জীবন বা প্রাকৃতিক দুর্যোগ) ব্যতিক্রম হওয়ার সুলুক সন্ধানে সহায়তা করে ‘এক্সট্রিম ভ্যালু থিওরি’। এটি গবেষকদের ‘অস্বাভাবিক তথ্য’ বিশ্লেষণ করে সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছাতেও সাহায্য করে।
এই নতুন গবেষণার ফলকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়েও কিছু বয়স্ক মানুষ আরও বেশি সময় বেঁচে ছিলেন। জেন ক্যালমেন্ট নামের একজন ফরাসি নাগরিক ১২২ বছর এবং ১৬৪ দিন বয়স পর্যন্ত বেঁচে ছিলেন। বিশ্বের সর্বাধিক বয়স্ক মানুষের রেকর্ডটিও এখন পর্যন্ত তার।
অবিশ্বাস্য দীর্ঘায়ু প্রাপ্ত কিছু মানুষ :
জেন ক্যালমেন্ট (১২২ বছর, ১৬৪ দিন)
জন্ম: ২১ ফেব্রুয়ারি, ১৮৭৫, আরলেস, ফ্রান্স
মৃত্যু: ৪ আগস্ট, ১৯৯৭
গুরুত্ব: ক্যালমেন্ট সবচেয়ে বেশি বয়সী মানব সন্তান হিসেবে রেকর্ড করেছেন। তিনি তার অস্বাভাবাবিক দীর্ঘায়ুর জন্য জলপাই তেল এবং চকলেটে সমৃদ্ধ ডায়েট এর পাশাপাশি একটি সক্রিয় জীবনযাত্রা কথা উল্লেখ করেছেন।
কেন তানাকা (১১৯ বছর, ১০৭ দিন)
মৃত্যু: ১৯ এপ্রিল, ২০২২
গুরুত্ব: তানাকাকে ২০১৯ সালে গিনেজ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস বিশ্বের সবচেয়ে বয়স্ক জীবিত ব্যক্তি হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। তার শখের মধ্যে ছিল বোর্ড গেম খেলা, পাজল সমাধান করা এবং সফট ড্রিংক পান করা।
সারা কনাউস (১১৯ বছর, ৯৭ দিন)
জন্ম: ২৪ সেপ্টেম্বর, ১৮৮০, পেনসিলভেনিয়া, যুক্তরাষ্ট্র
মৃত্যু: ৩০ ডিসেম্বর, ১৯৯৯
গুরুত্ব: কনাউস প্রায় তিনটি শতাব্দী দেখেছেন। তিনি শান্ত স্বভাব ও জীবন সম্পর্কে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির জন্য পরিচিত ছিলেন।
লুসিল র্যান্ডন (সিস্টার অ্যান্ড্রে) (১১৮ বছর, ৩৪০ দিন)
জন্ম: ১১ ফেব্রুয়ারি, ১৯০৪, অ্যালেস, ফ্রান্স
মৃত্যু: ১৭ জানুয়ারি, ২০২৩
গুরুত্ব: জীবনের বেশিরভাগ সময় একজন নান হিসেবে কাটিয়েছেন র্যান্ডন। নিজের দীর্ঘায়ুর কারণ হিসেবে দৈনিক প্রার্থনা এবং চকলেটের প্রতি ভালোবাসার কথা উল্লেখ করেছিলেন।
মারিয়া ব্রান্যাস মরেরা (১১৬+ বছর, নভেম্বর ২০২৪ পর্যন্ত জীবিত )
বর্তমান বাসস্থান: কাতালোনিয়া, স্পেন
গুরুত্ব: ২০২৪ সালের নভেম্বর মাস পর্যন্ত যাচাইকৃত তথ্য অনুযায়ী, ব্রান্যাস মরেরা বিশ্বের সবচেয়ে বয়স্ক জীবিত ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত।
জিরোএমন কিমুরা (১১৬ বছর, ৫৪ দিন)
জন্ম: ১৯ এপ্রিল, ১৮৯৭, কিয়োটো, জাপান
মৃত্যু: ১২ জুন, ২০১৩
গুরুত্ব: সর্বাধিক বয়স্ক পুরুষের রেকর্ডের অধিকারী। তার দীর্ঘায়ুর কারণ হিসেবে তিনি কম পরিমাণ খাবার এবং সহজ ডায়েটের কথা উল্লেখ করেছেন।
এই মানুষগুলোর অবিশ্বাস্য বয়স পুঙ্খানুপুঙ্খ নথি ও গবেষণার সাহায্যে নিশ্চিত করা হয়েছে, যা তাদেরকে সেইসব দাবি থেকে আলাদা করে যাদের দীর্ঘায়ু সম্পর্কিত যথেষ্ট প্রমাণ নেই।
দীর্ঘায়ু প্রাপ্তিতে জিন এবং জীবনযাত্রার ভূমিকা
ডাচ গবেষণায় মানুষের প্রাকৃতিক বয়সের একটি সীমা নির্দেশ করা হয়েছে। তবে এটি একজনের জীবনের দৈর্ঘ্যে প্রভাব ফেলার বিষয়গুলোকে উপেক্ষা করেনি। জিনতত্ত্ব, জীবনযাত্রা এবং পরিবেশগত অবস্থান- এ সবকিছুই একজন ব্যক্তির আয়ু নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
যেমন, নিয়মিত শরীরচর্চা, পুষ্টিকর খাবার খাওয়া, মস্তিষ্ককে সচল রাখা এবং মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণে রাখা- এই সবকিছুই আমাদের দীর্ঘ ও সুস্থ জীবন দিতে পারে। তাই, শুধু জিনতত্ত্বের ওপর নির্ভর না করে, আমাদের জীবনযাত্রার দিকেও নজর দেওয়া উচিত।
বৈজ্ঞানিক গবেষণায় দেখা গেছে, খাদ্যের গুণমান মানুষের স্বাস্থ্যের উপর গভীর প্রভাব ফেলে। অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ খাবার, ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড এবং প্রদাহরোধী পুষ্টি উপাদান কোষের স্বাস্থ্য উন্নত করে এবং আয়ু বাড়াতে সাহায্য করে। এছাড়াও, নিয়মিত ব্যায়াম এবং সক্রিয় জীবনযাপন করা দীর্ঘায়ুর জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
পরিবেশগত কারণও মানুষের আয়ুষ্কালের উপর প্রভাব ফেলে। দূষণ, প্রতিকূল আবহাওয়া এবং অস্বাস্থ্যকর জীবনযাপন আয়ু কমিয়ে দেয়। অন্যদিকে, পরিষ্কার ও নিরাপদ পরিবেশে বসবাস করা, উন্নত স্বাস্থ্যসেবা, পুষ্টিকর খাবার এবং সামাজিক সমর্থন জীবনযাত্রার মান উন্নত করে এবং আয়ু বাড়ায়।
সহজভাবে বললে, দীর্ঘ ও সুস্থ জীবন পেতে হলে ভালো খাদ্যাভ্যাস, নিয়মিত শরীরচর্চা এবং স্বাস্থ্যকর পরিবেশে বসবাস করা জরুরি।
গত কয়েক দশকে চিকিৎসা বিজ্ঞানের অভূতপূর্ব উন্নতি মানুষের গড় আয়ু বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। ডায়াবেটিস, ক্যান্সার এবং হৃদরোগের মতো জটিল রোগগুলোর চিকিৎসায় নতুন নতুন গবেষণা ও প্রযুক্তির ব্যবহার অসংখ্য মানুষের জীবন বাঁচিয়েছে। এছাড়াও, জিন থেরাপি এবং রিজেনারেটিভ মেডিসিনের মতো উদ্ভাবনী চিকিৎসা পদ্ধতি ভবিষ্যতে মানুষের আয়ু আরও বাড়ানোর সম্ভাবনা দেখাচ্ছে।
ভবিষ্যতে কী অপেক্ষা করছে?
চিকিৎসা প্রযুক্তির ক্রমাগত উন্নতির ফলে মানুষের গড় আয়ু আরও বাড়তে পারে। তবে, নেদারল্যান্ডস এর গবেষণা ইঙ্গিত দেয় যে, মানুষের জীবনকালের একটি প্রাকৃতিক সীমা থাকতে পারে। বিজ্ঞান এই সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করতে পারবে কিনা, তা এখনও নিশ্চিত নয়। তবে, মানুষের জীবনকাল নিয়ে গবেষণা চলতেই থাকবে এবং এর মাধ্যমে আমাদের জীবনের ধারণা আরও উন্নত হবে।
মানব জীবনকাল নিয়ে আলোচনা শুধু সংখ্যা নিয়ে নয়, বরং আমাদের জীবনযাপনের মানের উপরও নির্ভর করে। শুধু আয়ু বাড়ানোই যথেষ্ট নয়, জীবনের গুণমান উন্নত করাও সমান গুরুত্বপূর্ণ।
সাম্প্রতিক গবেষণা প্রমাণ করে যে, মানুষের আয়ুর একটি জৈবিক সীমা থাকতে পারে। তবে, বিজ্ঞানীরা এখনও দীর্ঘায়ু নিয়ে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন। মানুষের স্বাস্থ্য ও সুস্থতা উন্নত করার সম্ভাবনা একটি গুরুত্বপূর্ণ গবেষণার বিষয়।
(সূত্র: ফ্রি জুপিটার প্রকাশ সারাহ আভির লেখা থেকে ভাবানুবাদ।)