ঢাকা ০৫:৫৮ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৫, ২ বৈশাখ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম ::
Logo ইতিহাস গড়ল কেটি পেরি ও পাঁচ নারী, সফল ‘অল-ফিমেল’ মহাকাশযাত্রা Logo গরমে স্বস্তি দেবে যেসব খাবার Logo ফিলিস্তিনপন্থী বিক্ষোভ দমনে হাভার্ডের ২২০ কোটি ডলারের তহবিল স্থগিত করল ট্রাম্প প্রশাসন Logo সরকারি বরাদ্দে ১৯-২০ কোটি টাকা লোপাটের প্রাথমিক প্রমাণ পাওয়া গেছে Logo ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ডাকসু নির্বাচনের সময়রেখা ঘোষণা Logo আশা, সহনশীলতা আর পুনর্জাগরণের বার্তায় বর্ষবরণ, গাজায় নিহতদের স্মরণ Logo গসিপ বা পরচর্চা কি স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী? Logo মানুষ বেশিদিন বাঁচলেও আয়ুর সর্বোচ্চ সীমা কত? Logo রিতু মনির অনন্য লড়াইয়ে নাটকীয় জয়, শীর্ষে বাংলাদেশ Logo গণঅভ্যুত্থান বৈষম্যহীন সুখী বাংলাদেশ গড়ে তোলার প্রেরণা দিয়েছে : প্রধান উপদেষ্টা

গসিপ বা পরচর্চা কি স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী?

প্রতিনিধির নাম
  • আপডেট সময় : ১১:৩১:১৭ অপরাহ্ন, সোমবার, ১৪ এপ্রিল ২০২৫
  • / 6

গসিপ বা পরচর্চা

ডেইলি আর্থ অনলাইনের সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

ইংরেজি ‘গসিপ’ শব্দটির বাংলা অর্থ অনেকগুলো- পরচর্চা, গল্প, রটনা, চুটকি, খোশগল্প, আড্ডাবাজি, বাজে বকা ইত্যাদি। কোনও কোনও সময় আমরা চলতি কথায় বলি গুজুরগুজুর, ফুসুরফুসুর বা ফিসফাস ইত্যাদি। সাধারণত নেতিবাচকভাবেই ‘গসিপ’ পরিভাষা হিসেবে বাংলায় ব্যবহৃত হয়। তবে ‘গসিপ’ কিন্তু সবসময় খারাপ নয়।

‘যাক গে, আর কারও সম্পর্কে গসিপ করা উচিত নয়’- অনেকক্ষণ কারও বিষয়ে কথা বলার পর আমাদের গল্পের আসর অনেক সময়ই এভাবে শেষ হয়। শুধু আমরা কেন, পৃথিবীর অনেকেই আড্ডাটা শেষ করেন এভাবেই।

‘গসিপ’ বা পরচর্চাকে সবসময় অন্যের মানহানির জন্য লজ্জাজনক কাজ হিসেবে চিত্রিত করা হয়েছে, যা একটি প্রাণবন্ত গসিপের আসরের পরে আমাদের মনে অপরাধবোধের ছায়া ফেলে। বিভিন্ন ধর্মেও একে সামাজিক জীবন ধ্বংসকারী মন্দ কাজ বলে অভিহিত করা হয়েছে। যখন নির্লজ্জভাবে, অসাবধানতাবশত এবং দায়িত্বজ্ঞানহীনভাবে ‘গসিপ’ করা হয়, তখন এটি মানুষে মানুষে আন্তঃসম্পর্ক ও সামাজিক ভারসাম্য নষ্ট করে। তবুও, আমরা সবাই এতে লিপ্ত হই – জেনে বা না জেনে। গবেষকরাও তাই বলেন।

কিন্তু খারাপের বাইরেও পরচর্চা বা গসিপের কিছু স্বাস্থ্যকর দিক রয়েছে। সোজা বাংলায়- এর বেশ কিছু উপকারিতাও রয়েছে। মনোবিজ্ঞানীরা একে ‘সামাজিক আঠা’ বলে অভিহিত করেছেন, যা সম্প্রদায়কে একত্রিত করে। এটি মানসিক স্বাস্থ্যের জন্যও ভালো বলে বিবেচিত হয় (যখন এটি ক্ষতিকর নয়)।

ইতিবাচক গসিপ এবং এর উপকারিতা

মুম্বাইয়ের পরামর্শ মনোবিজ্ঞানী অ্যাবসি স্যাম বলেন,  “গসিপ বা পরচর্চা বন্ধন তৈরি, জ্ঞান ভাগ করে নেওয়া এবং তথ্য বিনিময়ের একটি উপায় হিসেবে কাজ করে। পারিবারের ভেতরে অনেক সময়ই গসিপ বন্ধন তৈরির একটি উপায়ও হতে পারে। এটি ব্যক্তির সামাজিক গতিশীলতা এবং সম্প্রদায়ের মধ্যে তাদের স্থান খুঁজে পেতে সাহায্য করে। অনেক সময়ই আবার এটি বিচ্ছিন্ন বা অশ্রুত ব্যক্তিদের কণ্ঠস্বরকে জোরদার করে- এমন গল্প এবং দৃষ্টিভঙ্গির দিকে মনোযোগ আকর্ষণ করে যা অন্যক্ষেত্রে হয়তো উপেক্ষা করা হয়েছিল।”

একটি হাউজিং সোসাইটির অ্যাপার্টমেন্টে বসবাসকারী এক তরুণীর ঘটনাই ধরা যাক। যিনি সাধারণত নিজের মতো থাকেন। তিনি হয়তো জানেনই না অন্যান্য ভাড়াটেদের তুলনায় বাড়িওয়ালা তার কাছ থেকে অন্যায়ভাবে বেশি ভাড়া নিচ্ছেন। একদিন একটি সাধারণ সন্ধ্যার আড্ডায়, প্রতিবেশীদের একটি দল তাদের ভাড়া নিয়ে আলোচনা করছিল, এবং কেউ একজন উল্লেখ করেন যে তারা একই রকম ফ্ল্যাটের জন্য কত টাকা দিচ্ছেন। কথাটি ছড়িয়ে পড়ে এবং শিগগিরই ওই তরুণী বুঝতে পারেন যে তার কাছ থেকে অনেক বেশি ভাড়া নেওয়া হচ্ছে। তিনি বাড়িওয়ালার মুখোমুখি হন এবং ন্যায্য ভাড়ার জন্য দর কষাকষি করেন বা অন্য বাসস্থান খুঁজতে শুরু করেন।

পরচর্চার মাধ্যমেই আমরা সমাজের অলিখিত সামাজিক নিয়মগুলো বুঝতে পারি। অন্যের গল্প থেকে আমরা শিখি। ‘গসিপ’ আবেগ প্রক্রিয়াকরণের উপায় বাতলে দিয়ে মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটায়। অন্য লোকেদের পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলা আমাদের ভাবতে সাহায্য করে- কী উপায়ে একই ধরনের চ্যালেঞ্জ আমরা মোকাবিলা করবো।

গসিপ থেকে সম্পূর্ণ বিরত থাকা, এমনকি বাস্তবসম্মত নাও হতে পারে। সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ, মনোবিজ্ঞানী এবং লেখক সোহিনী রোহরা বলেন, “যদি আপনি সংযোগ স্থাপন, বুঝতে বা পরামর্শ চাইতে এটি করেন, তবে এটি মানবিক। যদি এটি নাটকীয়তা তৈরি বা নিয়ন্ত্রণের জন্য হয়, তবে এটি ক্ষতিকর। অসাবধানী মন্তব্যের চেয়ে সচেতন যোগাযোগ – এটাই মূল কথা।”

ইচ্ছাকৃতভাবে কারও খ্যাতি নষ্ট করা বা লোকেদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করা অবশ্যই গসিপের ইতিবাচকতার অন্তর্ভুক্ত নয়। প্রকৃতপক্ষে, ভালো গসিপ একটি সামাজিক দক্ষতা – এর মানে আপনি নৈতিক সীমানা বোঝেন, ভালো বিচারবোধ রাখেন এবং জানেন কখন কোন তথ্যটি জানাতে হবে এবং কার সামনে কী বলতে হবে (এবং কী নয়)।

মনোবিজ্ঞানী রোহরা আরও বলেন, “আমি প্রায় সম্পূর্ণরূপে গসিপ থেকে বিরত থাকলেও, আমি দ্বিধাহীনভাবে বলছি যে আদর্শ গসিপ মানে বিশ্বকে বোঝার জন্য মানুষের কৌতূহল মাত্র। একজন মনোবিজ্ঞানী হিসেবে, আমি গোপনীয়তাকে পবিত্র মনে করি, তাই আমি ব্যক্তিগতভাবে গসিপে জড়িত হই না, বা আমি এটি করতে পারি না। কিন্তু মনস্তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে আমি বলতে পারি যে, যখন সহানুভূতি দিয়ে গসিপ করা হয়, তখন এটি এমনকি মানসিক স্বস্তি দিতে পারে, সামাজিক শিক্ষা প্রচার করতে পারে এবং মূল্যবোধ ভাগাভাগি নিশ্চিত করতে পারে।”

কীভাবে গসিপ করবেন (অরুচিকরভাবে নয়)

উদ্দেশ্য এবং অনুশীলনের মাধ্যমে, আপনি গসিপকে ৩৬০ ডিগ্রি রূপান্তর করে ইতিবাচক করতে পারেন। যার সম্পর্কে বলা হচ্ছে তাকে গল্পের নায়ক বানানো, মানুষের বিকাশ ও অগ্রগতির গল্প শেয়ার করা, এবং অনুমানভিত্তিক কিছু না ছড়ানো- এই ছোট ছোট মনোভাবের পরিবর্তন গসিপকেও ইতিবাচক ও অনুপ্রেরণামূলক করে তুলতে পারে।

মনোবিজ্ঞানী স্যাম বলেন, “এই ধরনের গসিপ অনুশীলন করার একটি উপায় হলো অন্যদের সম্পর্কে সহানুভূতির সঙ্গে কথা বলা। অনুমান করার পরিবর্তে, কেউ কী ধরনের পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে সেটি সহানুভূতি দিয়ে জানানোর চেষ্টা করুন। এটি ‘টি-স্পিলিং’ বা কারও ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে রসালো গপসপের চেয়ে বেশি পরিণত হতে হবে।”

এদিকে, মনোবিজ্ঞানী এবং গেটওয়ে অব হিলিং-এর প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ড. চাঁদনী তুগনাত স্বাস্থ্যকর ‘গসিপ’ অনুশীলন করতে বেশ কিছু পরামর্শ দিয়েছেন। এগুলো হলো-

নায়কের দৃষ্টিকোণ নিয়ম: কারও সম্পর্কে তথ্য জানানোর আগে, মানসিকভাবে গল্পের একটি চরিত্র হওয়ার পরিবর্তে নিছক তাদের নিজের গল্পের নায়ক হিসেবে মনে করুন। এই সূক্ষ্ম পরিবর্তন সমানুভূতি এবং প্রাসঙ্গিক বোঝাপড়াকে উৎসাহিত করে। এটি সম্ভাব্য সমালোচনাকে রূপান্তরিত করে ভিন্ন ‘দৃষ্টিকোণ’ থেকে আলোচনায়।

নিজের মনকে জেনে নিন: প্রথমেই নিজেকে জিজ্ঞাসা করুন – আমি ঠিক কী কারণে পরচর্চা করছি। সেটি কী সামাজিক সংযোগের জন্য, অভিজ্ঞতা ভাগাভাগি নাকি নিজের ভেতরে থাকা অশান্ত আবেগ প্রশমনের জন্য? রাগের মাথায় বা আবেগের বশে ‘গসিপ’ করলে, এমন অনেক কথা বেরিয়ে আসতে পারে যা আপনি আসলে বলতে চাননি। কিন্তু মন শান্ত থাকলে, আপনি চিন্তা করে কথা বলতে পারবেন এবং গসিপ থেকে নিজেকে দূরে রাখতে পারবেন।

সম্পূর্ণ গসিপ অনুশীলন করুন: যখন আপনি অন্যদের সম্পর্কে অর্ধেক শোনা বা অসম্পূর্ণ গল্প শোনেন, তখন ইচ্ছাকৃতভাবে সেই গল্পের বাদ দেওয়া বা হারিয়ে যাওয়া অংশগুলো নিয়ে ভাবুন বা জোড়া লাগানোর চেষ্টা করুন। পুরো গল্পটিতে তাদের খারাপ মানুষ হিসেবে না বিবেচনা করে বরং মানুষ হিসেবে বোঝার চেষ্টা করুন। সহানুভূতি দিয়ে গল্পের অসম্পূর্ণ অংশগুলো পূরণের এই সচেতন প্রচেষ্টা, কাউকে খারাপভাবে তুলে ধরার স্বাভাবিক প্রবণতাকে বাধা দেয়।

বেড়ে ওঠা ও সাফল্যের গসিপ অনুশীলন করুন: কেউ কীভাবে বেড়ে উঠেছেন, ইতিবাচকভাবে পরিবর্তিত হয়েছেন বা কতটা আবেগ দিয়ে একটি কঠিন পরিস্থিতি সামলেছেন- সেসব গল্প বলার চেষ্টা করুন। গসিপ সবসময় দোষ বা ভুলগুলো খুঁজে বের করার জন্য নয়। বরং, এটি মানুষের ভেতরের শক্তি, পরিবর্তন বা জ্ঞানকে তুলে ধরতে পারে। এর মাধ্যমে, আপনার কাছের মানুষদের মধ্যে এই ভালো গুণগুলো ছড়িয়ে দেওয়া যেতে পারে।

গল্প যত্ন নিন

যখন আপনি অন্যদের সম্পর্কে কিছু বলেন, তখন মনে রাখতে হবে সাময়িকভাবে তাদের জীবনের একটি অংশ তুলে ধরছেন। তাই তাদের জীবনের গল্পটিকে নিজের জীবনের গল্পের মতো যত্ন সহকারে বলুন। যদি কোনো ভুল তথ্য শোনেন, তবে তা সংশোধন করুন।

সততার একটি অদৃশ্য রেখা স্থাপন করুন

এমন কিছু তথ্য আছে, যা কখনোই কাউকে বলা উচিত নয়। নিজের মধ্যে এমন একটি অদৃশ্য সীমারেখা তৈরি করুন। এই ব্যক্তিগত অঙ্গীকার নিজের আত্মবিশ্বাস বাড়ায় এবং অন্যদের সম্পর্কে সংবেদনশীল তথ্যে আপনার স্নায়ুতন্ত্রের প্রতিক্রিয়া পরিবর্তন করে। এটি এমন একটি ভালো কাজ, যা অন্যদের দেখানোর প্রয়োজন নেই।

পরচর্চার যেসব একেবারেই নিষেধ

প্রথমত, যখন আপনি উত্তেজিত, রাগান্বিত বা অভিভূত হন, তখন কারও সম্পর্কে কথা বলা থেকে বিরত থাকুন। এই মুহূর্তগুলোতে আপনি যা বলতে চান, তা আপনার আসল অনুভূতি নাও হতে পারে।
স্যাম শেয়ার বলেন, “আবেগ ও উত্তেজনায় অনেক সময় এমন কথা মুখ দিয়ে বের হয়ে যেতে পারে যা আপনি আসলে বোঝাতে চাননি।” এসব মুহূর্তে নিজের আবেগকে শান্ত করতে কিছু সময় নিন।

দ্বিতীয়ত, অনুমান থেকে দূরে থাকতে হবে। কারো সম্পর্কে ‘তারা অবশ্যই এটি করেছে’ কিংবা ‘তারা এমনই’ রকমের উপসংহার না টেনে, ‘আমি ভাবছি, তাদের কী হয়েছে?’- এমন প্রশ্ন করতে শিখুন। এই ছোট্ট পরিবর্তন সহানুভূতি এবং সমানুভূতির জায়গা তৈরি করে।

ড. চাঁদনী তুগনাইতও কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিক মনে রাখতে পরামর্শ দিয়েছেন।

১. গসিপ যেন অন্য কাউকে নিচে নামিয়ে নিজেকে উন্নত করার উদ্দেশ্যে না হয়। যদি কথোপকথনের উদ্দেশ্য কাউকে অপমান করে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব দেখানো হয়, তবে সেটি নিজেরই নিরাপত্তাহীনতার প্রতীক।

২. যেকোনও দুর্বলতা বা গোপন তথ্য শেয়ার করা উচিত নয়। যদি কেউ তাদের ব্যক্তিগত সত্য আপনার সঙ্গে শেয়ার করেন, তা কখনোই অন্যদের কাছে প্রকাশ করবেন না।

৩. কারো মানসিক স্বাস্থ্য, ব্যক্তিগত সংগ্রাম বা পরিচয়ের বিষয়ে কখনো কথা বলবেন না। এসব গোপন বিষয়, যেগুলো অন্যের আঘাত কিংবা পরিচয়ের সঙ্গে সম্পর্কিত, আলোচনা করার বিষয় নয়।

৪. গসিপের সাথে হাস্যরস বা বিদ্রূপ মেশানো থেকে বিরত থাকুন। কোনো হাস্যরস যদি কাউকে অপমান করে, তা আর হাস্যরসের পর্যায়ে থাকে না; বরং এটি ক্ষতিকর হয়ে ওঠে।

এগুলো মেনে চললে, গসিপের মাঝে ইতিবাচকতা ও সহানুভূতি আনা যায়, যা একে আরও গঠনমূলক ও সদর্থক করে তোলে।

নিউজটি শেয়ার করুন

আপনার মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার ইমেইল এবং অন্যান্য তথ্য সংরক্ষন করুন

আপলোডকারীর তথ্য
ট্যাগস :

গসিপ বা পরচর্চা কি স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী?

আপডেট সময় : ১১:৩১:১৭ অপরাহ্ন, সোমবার, ১৪ এপ্রিল ২০২৫

ইংরেজি ‘গসিপ’ শব্দটির বাংলা অর্থ অনেকগুলো- পরচর্চা, গল্প, রটনা, চুটকি, খোশগল্প, আড্ডাবাজি, বাজে বকা ইত্যাদি। কোনও কোনও সময় আমরা চলতি কথায় বলি গুজুরগুজুর, ফুসুরফুসুর বা ফিসফাস ইত্যাদি। সাধারণত নেতিবাচকভাবেই ‘গসিপ’ পরিভাষা হিসেবে বাংলায় ব্যবহৃত হয়। তবে ‘গসিপ’ কিন্তু সবসময় খারাপ নয়।

‘যাক গে, আর কারও সম্পর্কে গসিপ করা উচিত নয়’- অনেকক্ষণ কারও বিষয়ে কথা বলার পর আমাদের গল্পের আসর অনেক সময়ই এভাবে শেষ হয়। শুধু আমরা কেন, পৃথিবীর অনেকেই আড্ডাটা শেষ করেন এভাবেই।

‘গসিপ’ বা পরচর্চাকে সবসময় অন্যের মানহানির জন্য লজ্জাজনক কাজ হিসেবে চিত্রিত করা হয়েছে, যা একটি প্রাণবন্ত গসিপের আসরের পরে আমাদের মনে অপরাধবোধের ছায়া ফেলে। বিভিন্ন ধর্মেও একে সামাজিক জীবন ধ্বংসকারী মন্দ কাজ বলে অভিহিত করা হয়েছে। যখন নির্লজ্জভাবে, অসাবধানতাবশত এবং দায়িত্বজ্ঞানহীনভাবে ‘গসিপ’ করা হয়, তখন এটি মানুষে মানুষে আন্তঃসম্পর্ক ও সামাজিক ভারসাম্য নষ্ট করে। তবুও, আমরা সবাই এতে লিপ্ত হই – জেনে বা না জেনে। গবেষকরাও তাই বলেন।

কিন্তু খারাপের বাইরেও পরচর্চা বা গসিপের কিছু স্বাস্থ্যকর দিক রয়েছে। সোজা বাংলায়- এর বেশ কিছু উপকারিতাও রয়েছে। মনোবিজ্ঞানীরা একে ‘সামাজিক আঠা’ বলে অভিহিত করেছেন, যা সম্প্রদায়কে একত্রিত করে। এটি মানসিক স্বাস্থ্যের জন্যও ভালো বলে বিবেচিত হয় (যখন এটি ক্ষতিকর নয়)।

ইতিবাচক গসিপ এবং এর উপকারিতা

মুম্বাইয়ের পরামর্শ মনোবিজ্ঞানী অ্যাবসি স্যাম বলেন,  “গসিপ বা পরচর্চা বন্ধন তৈরি, জ্ঞান ভাগ করে নেওয়া এবং তথ্য বিনিময়ের একটি উপায় হিসেবে কাজ করে। পারিবারের ভেতরে অনেক সময়ই গসিপ বন্ধন তৈরির একটি উপায়ও হতে পারে। এটি ব্যক্তির সামাজিক গতিশীলতা এবং সম্প্রদায়ের মধ্যে তাদের স্থান খুঁজে পেতে সাহায্য করে। অনেক সময়ই আবার এটি বিচ্ছিন্ন বা অশ্রুত ব্যক্তিদের কণ্ঠস্বরকে জোরদার করে- এমন গল্প এবং দৃষ্টিভঙ্গির দিকে মনোযোগ আকর্ষণ করে যা অন্যক্ষেত্রে হয়তো উপেক্ষা করা হয়েছিল।”

একটি হাউজিং সোসাইটির অ্যাপার্টমেন্টে বসবাসকারী এক তরুণীর ঘটনাই ধরা যাক। যিনি সাধারণত নিজের মতো থাকেন। তিনি হয়তো জানেনই না অন্যান্য ভাড়াটেদের তুলনায় বাড়িওয়ালা তার কাছ থেকে অন্যায়ভাবে বেশি ভাড়া নিচ্ছেন। একদিন একটি সাধারণ সন্ধ্যার আড্ডায়, প্রতিবেশীদের একটি দল তাদের ভাড়া নিয়ে আলোচনা করছিল, এবং কেউ একজন উল্লেখ করেন যে তারা একই রকম ফ্ল্যাটের জন্য কত টাকা দিচ্ছেন। কথাটি ছড়িয়ে পড়ে এবং শিগগিরই ওই তরুণী বুঝতে পারেন যে তার কাছ থেকে অনেক বেশি ভাড়া নেওয়া হচ্ছে। তিনি বাড়িওয়ালার মুখোমুখি হন এবং ন্যায্য ভাড়ার জন্য দর কষাকষি করেন বা অন্য বাসস্থান খুঁজতে শুরু করেন।

পরচর্চার মাধ্যমেই আমরা সমাজের অলিখিত সামাজিক নিয়মগুলো বুঝতে পারি। অন্যের গল্প থেকে আমরা শিখি। ‘গসিপ’ আবেগ প্রক্রিয়াকরণের উপায় বাতলে দিয়ে মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটায়। অন্য লোকেদের পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলা আমাদের ভাবতে সাহায্য করে- কী উপায়ে একই ধরনের চ্যালেঞ্জ আমরা মোকাবিলা করবো।

গসিপ থেকে সম্পূর্ণ বিরত থাকা, এমনকি বাস্তবসম্মত নাও হতে পারে। সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ, মনোবিজ্ঞানী এবং লেখক সোহিনী রোহরা বলেন, “যদি আপনি সংযোগ স্থাপন, বুঝতে বা পরামর্শ চাইতে এটি করেন, তবে এটি মানবিক। যদি এটি নাটকীয়তা তৈরি বা নিয়ন্ত্রণের জন্য হয়, তবে এটি ক্ষতিকর। অসাবধানী মন্তব্যের চেয়ে সচেতন যোগাযোগ – এটাই মূল কথা।”

ইচ্ছাকৃতভাবে কারও খ্যাতি নষ্ট করা বা লোকেদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করা অবশ্যই গসিপের ইতিবাচকতার অন্তর্ভুক্ত নয়। প্রকৃতপক্ষে, ভালো গসিপ একটি সামাজিক দক্ষতা – এর মানে আপনি নৈতিক সীমানা বোঝেন, ভালো বিচারবোধ রাখেন এবং জানেন কখন কোন তথ্যটি জানাতে হবে এবং কার সামনে কী বলতে হবে (এবং কী নয়)।

মনোবিজ্ঞানী রোহরা আরও বলেন, “আমি প্রায় সম্পূর্ণরূপে গসিপ থেকে বিরত থাকলেও, আমি দ্বিধাহীনভাবে বলছি যে আদর্শ গসিপ মানে বিশ্বকে বোঝার জন্য মানুষের কৌতূহল মাত্র। একজন মনোবিজ্ঞানী হিসেবে, আমি গোপনীয়তাকে পবিত্র মনে করি, তাই আমি ব্যক্তিগতভাবে গসিপে জড়িত হই না, বা আমি এটি করতে পারি না। কিন্তু মনস্তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে আমি বলতে পারি যে, যখন সহানুভূতি দিয়ে গসিপ করা হয়, তখন এটি এমনকি মানসিক স্বস্তি দিতে পারে, সামাজিক শিক্ষা প্রচার করতে পারে এবং মূল্যবোধ ভাগাভাগি নিশ্চিত করতে পারে।”

কীভাবে গসিপ করবেন (অরুচিকরভাবে নয়)

উদ্দেশ্য এবং অনুশীলনের মাধ্যমে, আপনি গসিপকে ৩৬০ ডিগ্রি রূপান্তর করে ইতিবাচক করতে পারেন। যার সম্পর্কে বলা হচ্ছে তাকে গল্পের নায়ক বানানো, মানুষের বিকাশ ও অগ্রগতির গল্প শেয়ার করা, এবং অনুমানভিত্তিক কিছু না ছড়ানো- এই ছোট ছোট মনোভাবের পরিবর্তন গসিপকেও ইতিবাচক ও অনুপ্রেরণামূলক করে তুলতে পারে।

মনোবিজ্ঞানী স্যাম বলেন, “এই ধরনের গসিপ অনুশীলন করার একটি উপায় হলো অন্যদের সম্পর্কে সহানুভূতির সঙ্গে কথা বলা। অনুমান করার পরিবর্তে, কেউ কী ধরনের পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে সেটি সহানুভূতি দিয়ে জানানোর চেষ্টা করুন। এটি ‘টি-স্পিলিং’ বা কারও ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে রসালো গপসপের চেয়ে বেশি পরিণত হতে হবে।”

এদিকে, মনোবিজ্ঞানী এবং গেটওয়ে অব হিলিং-এর প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ড. চাঁদনী তুগনাত স্বাস্থ্যকর ‘গসিপ’ অনুশীলন করতে বেশ কিছু পরামর্শ দিয়েছেন। এগুলো হলো-

নায়কের দৃষ্টিকোণ নিয়ম: কারও সম্পর্কে তথ্য জানানোর আগে, মানসিকভাবে গল্পের একটি চরিত্র হওয়ার পরিবর্তে নিছক তাদের নিজের গল্পের নায়ক হিসেবে মনে করুন। এই সূক্ষ্ম পরিবর্তন সমানুভূতি এবং প্রাসঙ্গিক বোঝাপড়াকে উৎসাহিত করে। এটি সম্ভাব্য সমালোচনাকে রূপান্তরিত করে ভিন্ন ‘দৃষ্টিকোণ’ থেকে আলোচনায়।

নিজের মনকে জেনে নিন: প্রথমেই নিজেকে জিজ্ঞাসা করুন – আমি ঠিক কী কারণে পরচর্চা করছি। সেটি কী সামাজিক সংযোগের জন্য, অভিজ্ঞতা ভাগাভাগি নাকি নিজের ভেতরে থাকা অশান্ত আবেগ প্রশমনের জন্য? রাগের মাথায় বা আবেগের বশে ‘গসিপ’ করলে, এমন অনেক কথা বেরিয়ে আসতে পারে যা আপনি আসলে বলতে চাননি। কিন্তু মন শান্ত থাকলে, আপনি চিন্তা করে কথা বলতে পারবেন এবং গসিপ থেকে নিজেকে দূরে রাখতে পারবেন।

সম্পূর্ণ গসিপ অনুশীলন করুন: যখন আপনি অন্যদের সম্পর্কে অর্ধেক শোনা বা অসম্পূর্ণ গল্প শোনেন, তখন ইচ্ছাকৃতভাবে সেই গল্পের বাদ দেওয়া বা হারিয়ে যাওয়া অংশগুলো নিয়ে ভাবুন বা জোড়া লাগানোর চেষ্টা করুন। পুরো গল্পটিতে তাদের খারাপ মানুষ হিসেবে না বিবেচনা করে বরং মানুষ হিসেবে বোঝার চেষ্টা করুন। সহানুভূতি দিয়ে গল্পের অসম্পূর্ণ অংশগুলো পূরণের এই সচেতন প্রচেষ্টা, কাউকে খারাপভাবে তুলে ধরার স্বাভাবিক প্রবণতাকে বাধা দেয়।

বেড়ে ওঠা ও সাফল্যের গসিপ অনুশীলন করুন: কেউ কীভাবে বেড়ে উঠেছেন, ইতিবাচকভাবে পরিবর্তিত হয়েছেন বা কতটা আবেগ দিয়ে একটি কঠিন পরিস্থিতি সামলেছেন- সেসব গল্প বলার চেষ্টা করুন। গসিপ সবসময় দোষ বা ভুলগুলো খুঁজে বের করার জন্য নয়। বরং, এটি মানুষের ভেতরের শক্তি, পরিবর্তন বা জ্ঞানকে তুলে ধরতে পারে। এর মাধ্যমে, আপনার কাছের মানুষদের মধ্যে এই ভালো গুণগুলো ছড়িয়ে দেওয়া যেতে পারে।

গল্প যত্ন নিন

যখন আপনি অন্যদের সম্পর্কে কিছু বলেন, তখন মনে রাখতে হবে সাময়িকভাবে তাদের জীবনের একটি অংশ তুলে ধরছেন। তাই তাদের জীবনের গল্পটিকে নিজের জীবনের গল্পের মতো যত্ন সহকারে বলুন। যদি কোনো ভুল তথ্য শোনেন, তবে তা সংশোধন করুন।

সততার একটি অদৃশ্য রেখা স্থাপন করুন

এমন কিছু তথ্য আছে, যা কখনোই কাউকে বলা উচিত নয়। নিজের মধ্যে এমন একটি অদৃশ্য সীমারেখা তৈরি করুন। এই ব্যক্তিগত অঙ্গীকার নিজের আত্মবিশ্বাস বাড়ায় এবং অন্যদের সম্পর্কে সংবেদনশীল তথ্যে আপনার স্নায়ুতন্ত্রের প্রতিক্রিয়া পরিবর্তন করে। এটি এমন একটি ভালো কাজ, যা অন্যদের দেখানোর প্রয়োজন নেই।

পরচর্চার যেসব একেবারেই নিষেধ

প্রথমত, যখন আপনি উত্তেজিত, রাগান্বিত বা অভিভূত হন, তখন কারও সম্পর্কে কথা বলা থেকে বিরত থাকুন। এই মুহূর্তগুলোতে আপনি যা বলতে চান, তা আপনার আসল অনুভূতি নাও হতে পারে।
স্যাম শেয়ার বলেন, “আবেগ ও উত্তেজনায় অনেক সময় এমন কথা মুখ দিয়ে বের হয়ে যেতে পারে যা আপনি আসলে বোঝাতে চাননি।” এসব মুহূর্তে নিজের আবেগকে শান্ত করতে কিছু সময় নিন।

দ্বিতীয়ত, অনুমান থেকে দূরে থাকতে হবে। কারো সম্পর্কে ‘তারা অবশ্যই এটি করেছে’ কিংবা ‘তারা এমনই’ রকমের উপসংহার না টেনে, ‘আমি ভাবছি, তাদের কী হয়েছে?’- এমন প্রশ্ন করতে শিখুন। এই ছোট্ট পরিবর্তন সহানুভূতি এবং সমানুভূতির জায়গা তৈরি করে।

ড. চাঁদনী তুগনাইতও কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিক মনে রাখতে পরামর্শ দিয়েছেন।

১. গসিপ যেন অন্য কাউকে নিচে নামিয়ে নিজেকে উন্নত করার উদ্দেশ্যে না হয়। যদি কথোপকথনের উদ্দেশ্য কাউকে অপমান করে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব দেখানো হয়, তবে সেটি নিজেরই নিরাপত্তাহীনতার প্রতীক।

২. যেকোনও দুর্বলতা বা গোপন তথ্য শেয়ার করা উচিত নয়। যদি কেউ তাদের ব্যক্তিগত সত্য আপনার সঙ্গে শেয়ার করেন, তা কখনোই অন্যদের কাছে প্রকাশ করবেন না।

৩. কারো মানসিক স্বাস্থ্য, ব্যক্তিগত সংগ্রাম বা পরিচয়ের বিষয়ে কখনো কথা বলবেন না। এসব গোপন বিষয়, যেগুলো অন্যের আঘাত কিংবা পরিচয়ের সঙ্গে সম্পর্কিত, আলোচনা করার বিষয় নয়।

৪. গসিপের সাথে হাস্যরস বা বিদ্রূপ মেশানো থেকে বিরত থাকুন। কোনো হাস্যরস যদি কাউকে অপমান করে, তা আর হাস্যরসের পর্যায়ে থাকে না; বরং এটি ক্ষতিকর হয়ে ওঠে।

এগুলো মেনে চললে, গসিপের মাঝে ইতিবাচকতা ও সহানুভূতি আনা যায়, যা একে আরও গঠনমূলক ও সদর্থক করে তোলে।