জাল দলিলে ৫০ কোটি টাকা ব্যাংক ঋণ!
- আপডেট সময় : ০৪:৩৫:১৭ অপরাহ্ন, শনিবার, ৪ মে ২০২৪
- / 51
ভুয়া তথ্য দিয়ে নামে-বেনামে একাধিক জাল জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) ও করদাতা শনাক্তকরণ নম্বর (টিআইএন) তৈরি করতো একটি সংঘবদ্ধ চক্র। সে সব এনআইডি ও টিআইএন নম্বর দিয়ে রেজিস্ট্রি অফিসের কিছু অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজশে ফ্ল্যাটের ভুয়া দলিল তৈরি করতো চক্রের সদস্যরা। পরে এ সব দলিল বিভিন্ন ব্যাংকে মর্টগেজ (বন্ধকি ঋণ) দিয়ে মোটা অঙ্কের টাকা ঋণ নিতো। এভাবে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ৫০ কোটি টাকা ঋণ নেয় চক্রটি।
শনিবার (৪ মে) দুপুরে রাজধানীর মালিবাগে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) প্রধান কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এ সব তথ্য জানান সংস্থাটির প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি মোহাম্মদ আলী মিয়া।
শুক্রবার (৩ এপ্রিল) রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে ওই সাত জনকে গ্রেফতার করেছে সিআইডির ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইম ইউনিট। এর আগে, একই চক্রে চার জনকে গ্রেফতার করে সিআইডি। তাদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে শুক্রবার অভিযান চালানো হয়।
গ্রেফতার সাত জন হলেন– চক্রের ‘মূল হোতা’ জয়নাল আবেদীন ইদ্রিস, তার ‘প্রধান সহযোগী’ মো. রাকিব হোসেন (৩৩), জয়নালের ভায়রা কে এম মোস্তাফিজুর রহমান (৫৪), ‘জাল কাগজপত্র ও এনআইডি’ প্রস্তুতকারক মো.লিটন মাহমুদ (৪০), ভূমি রেজিস্ট্রি অফিসের দলিল প্রস্তুতকারক হাবিবুর রহমান মিঠু (৩০), এনআরবিসির ব্যাংক কর্মকর্তা হিরু মোল্যা (৪৪), আব্দুস সাত্তার (৫৪) ও সৈয়দ তারেক আলী (৫৪)। তাদের কাছ থেকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সিলমোহর, একই ব্যক্তির একাধিক এনআইডি ও টিআইএন নম্বর, মোবাইল ফোন, বিভিন্ন ব্যাংকের ডেবিট ও ক্রেডিট কার্ডসহ নগদ ৩ লাখ টাকা জব্দ করা হয়।
অতিরিক্ত আইজিপি মোহাম্মদ আলী মিয়া বলেন, ‘সম্প্রতি সিআইডির ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইম ইউনিট গোপন সূত্রে জানতে পারে, একটি সংঘবদ্ধ অপরাধী চক্র জাতীয় পরিচয়পত্র নিবন্ধন পরিদফতরের কিছু অসাধু সদস্যের সহযোগিতায় একাধিক এনআইডি ও টিআইএন তৈরি করে আসছে। পরে তা ব্যবহার করে ভূমি রেজিস্ট্রি অফিসের অসাধু লোকদের মাধ্যমে চক্রের সদস্যদের নামে ফ্ল্যাট বা জমির একাধিক মূল দলিল তৈরি করছে। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অসাধু কর্মকর্তাদের যোগসাজশে এ সব জাল দলিল ব্যবহার করে বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে একেকটি ফ্ল্যাটের বিপরীতে একাধিক লোন নিয়ে প্রায় ৫০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করে চক্রটি।’
তিনি বলেন, ‘দীর্ঘ অনুসন্ধানে জানা যায়, এ চক্রের মূল হোতা জয়নাল। চক্রের সদস্যরা প্রথমে রাজধানীর বিভিন্ন অভিজাত এলাকায় বিলাসবহুল ফ্ল্যাটের ক্রেতা হিসেবে হাজির হতো। শুরুতে মোটা অঙ্কের টাকা দিয়ে ফ্ল্যাট বায়না করতো। এরপর ফ্ল্যাটের মালিকানার তথ্য যাচাইয়ের কথা বলে মালিকের কাছ থেকে দলিল এবং অন্যান্য কাগজপত্রের কপি সংগ্রহ করতো। সে সব দলিল ও কাগজপত্রের তথ্য নিয়ে ভূমি রেজিস্ট্রি অফিসের অসাধু লোকদের মাধ্যমে তৈরি করতো জাল দলিল। দলিলে কখনও নিজে মালিক আবার কখনও চক্রের অন্য সদস্যদের মালিক বানাতো জয়নাল। সেই জাল দলিল দিয়ে পাততো ফ্ল্যাট বিক্রির ফাঁদ! ফ্ল্যাট পছন্দ করলে ক্রেতার কাছ থেকে বায়না বাবদ অগ্রিম টাকাও নিতো জয়নাল। এছাড়া ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কিছু কর্মকর্তার যোগসাজশে জাল দলিল দেখিয়ে ক্রেতা সেজে ব্যাংক ঋণ নিতো চক্রের সদস্যরাও।’
তিনি আরও বলেন, ‘চক্রটি ফাঁদ পেতে জাল দলিলের মাধ্যমে বহু ফ্ল্যাট মালিককে পথে বসিয়েছে। এ ছাড়া সম্ভাব্য ফ্ল্যাট ক্রেতাদের কাছ থেকে অগ্রিম টাকা নিতো এবং বাকি টাকার জন্য তাদের ওপরও ব্যাংক ঋণের বোঝা চাপিয়ে দিতো।’
সিআইডিপ্রধান বলেন, ‘জয়নালের মালিকাধীন প্রতিষ্ঠান রুমানা জুয়েলার্স, নীড় এস্টেট প্রোপার্টিস লিমিটেড, স্নেহা এন্টারপ্রাইজ, ইআর ইন্টারন্যাশনালসহ চক্রের ২৫ সদস্যের বিরুদ্ধে ডিএমপির উত্তরা-পূর্ব থানায় মানিলন্ডারিং আইনে মামলা দায়ের করেছে সিআইডি।’
তিনি বলেন, ‘গ্রেফতার ব্যক্তিদের জিজ্ঞাসাবাদে জানা গেছে, চক্রটির সঙ্গে জাতীয় পরিচয়পত্র নিবন্ধন পরিদফতরের কিছু অসাধু কর্মকর্তা ও দালাল, ভূমি রেজিস্ট্রি অফিসের অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী, বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অসাধু ব্যাংকার জড়িত।’
তিনি বলেন, ‘জয়নাল মিরপুরে কোঅপারেটিভ মার্কেটের একটি স্বর্ণের দোকানের কর্মচারী ছিল। পরে সে ও শহিদুল ইসলাম সবুজ মিলে ফ্ল্যাট জালিয়াতি শুরু করে। এ চক্রের সঙ্গে জড়িত হয়ে শতকোটি টাকার মালিক বনে যায় জয়নাল। তার অন্যতম প্রধান সহযোগী দুই স্ত্রী রোমানা সিদ্দিক ও রাবেয়া আক্তার মুক্তা। প্রতারণার জন্য নিজ নামে ছয়টি সক্রিয় এনআইডি ব্যবহার করে জয়নাল। এ সব এনআইডি দিয়ে বিভিন্ন ব্যাংকে ৫০টির বেশি হিসাব খুলেছে। বসুন্ধার আবাসিক এলাকায় সাততলা বাড়ি, তিনটি ফ্ল্যাট, মিরপুর ও আশকোনায় তিনটি ফ্ল্যাট রয়েছে তার।’
নিউজটি শেয়ার করুন