ঢাকা ০৫:২৫ অপরাহ্ন, বুধবার, ৩০ অক্টোবর ২০২৪, ১৫ কার্তিক ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

 

সহসাই হচ্ছে না ব্যাংক একীভূতকরণ

অনলাইন ডেস্ক
  • আপডেট সময় : ১২:১৫:৩৬ অপরাহ্ন, রবিবার, ১৪ জুলাই ২০২৪
  • / 50
ডেইলি আর্থ অনলাইনের সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

 

দীর্ঘদিন ধরেই নানা সমস্যায় ধুঁকছে দেশের ব্যাংক ও আর্থিক খাত। অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা আর খেলাপি ঋণের চাপে বেকায়দায় অনেক প্রতিষ্ঠান। ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর অবস্থা খুবই নাজুক। ফলে একদিকে যেমন দিন দিন আমানত কমছে, অন্যদিকে আমানতকারীও হারাতে শুরু করেছে এসব খাত।

এ অবস্থায় নিজেদের অবস্থান ধরে রাখতে পারছে না অনেক ব্যাংক। তারল্য পরিস্থিতি যেমন খারাপ, আবার এসব ব্যাংককে চলতে হচ্ছে অন্য ব্যাংক থেকে ধার নিয়ে। একীভূতকরণ হলে অধিগ্রহণকারী ব্যাংকের মাধ্যমে ছাঁটাইয়ের কবলে পড়ার শঙ্কায় আছেন দুর্বল ব্যাংকের কর্মীরা।

দুর্বল ব্যাংক একীভূতকরণের সিদ্ধান্ত
ব্যাংকখাতে গতি ও স্থিতিশীলতা ফেরাতে দুর্বল ব্যাংকগুলোকে অন্য ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করার সিদ্ধান্ত হয়। এরই অংশ হিসেবে চারটি ব্যাংকের মধ্যে সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) সই হয়ে গেছে। তবে নিজেদের দুর্বল প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে এখনো সিদ্ধান্তহীনতায় খোদ প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মকর্তারা। তারা মনে করছেন, একীভূত করলে দ্রুতই করা উচিত, তা না হলেও সিদ্ধান্ত জানানো দরকার। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, সামগ্রিকভাবে কাজ চলমান। চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের জন্য আরও অপেক্ষা করতে হবে।

খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ব্যাংক একীভূত করার ঘোষণা ২০২৪ সালের বার্ষিক রিপোর্টের ভিত্তিতে হওয়ার কথা। ২০২৪ সালের প্রতিবেদনটি প্রকাশ হবে ২০২৫ সালের জুন মাসে। এ আর্থিক প্রতিবেদনের ওপর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের চাপিয়ে দেওয়া তড়িঘড়ি সিদ্ধান্তে বিষয়টি অনেকটাই ভেস্তে আছে।

একীভূতকরণ কতদূর
প্রতিবেদন প্রকাশ এবং সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করতে এখনো অনেক সময় অপেক্ষা করতে হবে। অন্যদিকে, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বেসিক ব্যাংককে রাষ্ট্রায়ত্ত বলে স্বীকার না করেই আলোচনার জন্ম দেয় খোদ বাংলাদেশ ব্যাংক। তড়িঘড়ি সিদ্ধান্ত আর বেসিক ব্যাংককে রাষ্ট্রীয় বলে স্বীকার না করা নিয়ে শুরু হয় সমালোচনা। এতেই অনেকটা পথ হারায় একীভূতকরণ ইস্যুটি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি সূত্র বলছে, দেশের দুর্বল ব্যাংকগুলো চলতি বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত স্বেচ্ছায় একীভূত ও অধিগ্রহণের সুযোগ দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ সময়ের মধ্যে তারা ব্যর্থ হলে ২০২৫ সালের মার্চ থেকে একীভূতকরণ ও অধিগ্রহণের উদ্যোগ নেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

এর আগে গত বছরের ডিসেম্বরে কিছু ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের আর্থিক অবস্থার অবনতির মধ্যে একীভূতকরণ ও অধিগ্রহণের দিকনির্দেশনা দিতে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রম্পট কারেকটিভ অ্যাকশন (পিসিএ) ফ্রেমওয়ার্ক নামে একটি গাইডলাইন করে। এ উদ্যোগে সঞ্চয়কারীসহ অনেকের মধ্যে উদ্বেগ দেখা দেয়।

চলতি বছরের ১৮ মার্চ ব্যাংক একীভূতকরণ প্রক্রিয়া শুরু করতে এক্সিম ব্যাংক ও পদ্মা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের মধ্যে একটি এমওইউ সই হয়। গভর্নরের উপস্থিতিতে এ চুক্তি সই অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়। এরপর গত ১৩ মে রাষ্ট্র মালিকানাধীন সোনালী ব্যাংকের সঙ্গে ‘স্বেচ্ছায় একীভূত’ হওয়ার জন্য সমঝোতা চুক্তি করে বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেড (বিডিবিএল)।

চুক্তি সইয়ের পর এখন এসব ব্যাংকের সম্পদ ও দায় পর্যালোচনা করার কথা। এরপরই নানা প্রক্রিয়া শেষে একীভূত হবে ব্যাংকগুলো। এদিকে, একীভূত হওয়ার খবরে আতঙ্ক তৈরি হয় ওইসব ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে। কারণ, নীতিমালা অনুযায়ী একীভূত হওয়ার তিন বছর পর দুর্বল ব্যাংকের কর্মীদের কর্মদক্ষতা বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নিতে পারবে অধিগ্রহণকারী ব্যাংক। এতে একীভূতকারী ব্যাংকের মাধ্যমে ছাঁটাই হওয়ার আশঙ্কায় পড়েন তারা।

কেন দেরি একীভূতকরণ প্রক্রিয়ায়
একীভূত করা নিয়ে অনেক দিন ধরে আলোচনা হলেও গত ৩১ জানুয়ারি ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীদের সঙ্গে এক বৈঠকে বাংলাদেশ ব্যাংক দুর্বল ব্যাংকগুলোকে একীভূত করার পরামর্শ দেয়। এরপর গত ১৪ মার্চ এক্সিম ব্যাংক ও পদ্মা ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ একে অপরের সঙ্গে একীভূত হওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। গত ৩ এপ্রিল সরকারি খাতের রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংককে (রাকাব) বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের সঙ্গে এবং বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংককে (বিডিবিএল) সোনালী ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করার সিদ্ধান্ত হয়। এরপর ৮ এপ্রিল বেসরকারি খাতের ভালো ব্যাংকের তালিকায় থাকা সিটি ব্যাংকের সঙ্গে সমস্যাগ্রস্ত বেসিক ব্যাংককে এবং ৯ এপ্রিল বেসরকারি ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক বা ইউসিবির সঙ্গে ন্যাশনাল ব্যাংককে একীভূত করার সিদ্ধান্ত হয়।

এরপর ১৬ এপ্রিল ‘বেসিক ব্যাংক সরকারি নয়’ বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্রের দেওয়া বক্তব্যে বিভ্রান্তি তৈরি হয়। সেই বিভ্রান্তি দূর করতে নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করে বেসিক ব্যাংক।

এ নিয়ে ব্যাখ্যায় বেসিক ব্যাংক কর্তৃপক্ষ জানায়, অন্য সরকারি ব্যাংকগুলোর মতোই বেসিক ব্যাংকও একই পরিচালন কাঠামো, নীতিমালা ও বেতন কাঠামোর আওতায় পরিচালিত হয়ে আসছে। অভিযোগ যায় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় পর্যন্ত। আরেকটি বেসরকারি ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হতে চায় না বলে আনুষ্ঠানিকভাবে সরকারকে চিঠি দিয়ে জানায় বেসিক ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ। অন্যদিকে ন্যাশনাল ব্যাংকও একীভূত হবে না বলে গত ৬ মে আনুষ্ঠানিকভাবে সংবাদ সম্মেলন করে জানায়। এরপর কচ্ছপ গতি পায় অন্য ব্যাংকগুলোর একীভূতকরণ প্রক্রিয়ায়।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও ভারপ্রাপ্ত মুখপাত্র সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘যে ব্যাংকগুলোর এমওইউ চুক্তি হয়েছে সেসব ব্যাংকে অডিট নিয়োগ করা হয়েছে। এখানে দেনা-পাওনার বিষয় আছে। অডিটর যে মেসেজগুলো করবেন তার জন্য সময় লাগবে, চাইলেই দ্রুত হবে না, একীভূতকরণের প্রসেসটা দীর্ঘ সময়ের। এখানে দুটো প্রতিষ্ঠানের অনেক ফ্যাক্টর থাকে, সেগুলো মেলাতে হয়। দেনা-পাওনা কী পরিমাণ সেগুলোও দেখতে হয়। এরপর স্কিম রেডি করা এবং কোর্টের অনুমোদন নিতে হয়।’

সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘কোনো ব্যাংককে একীভূত করতে সবশেষ হাইকোর্টের অনুমতি থাকতে হবে, কোনো পার্টির ক্লেম থাকা যাবে না। এরই মধ্যে প্রতিষ্ঠানগুলোয় অডিটর নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। পদ্মা-এক্সিম ব্যাংকের অডিটের কাজ অনেকটা এগিয়েছে। তবে দেরিতে চুক্তি হওয়ায় সোনালী-বিডিবিএলের অডিট রিপোর্ট তৈরিতে আরও কিছুটা দেরি হবে। একীভূত প্রতিষ্ঠান দুটোর স্টেকহোল্ডার যারা আছেন, সেখানেও ব্যাপক দেনা-পাওনার বিষয়সহ স্বচ্ছতা-জবাবদিহির বিষয় রয়েছে। যারা তড়িঘড়ির কথা বলছেন তারা না বুঝেই বলছেন।’

চাকরি হারানোর শঙ্কায় আতঙ্কিত কর্মীরা
বেসরকারি পদ্মা ও এক্সিম ব্যাংকের মধ্যে এমওইউ হওয়ার পরপরই চাকরি হারানোর শঙ্কা দানা বাঁধে পদ্মা ব্যাংক কর্মীদের মধ্যে। তাদের অনেকেই মনে করছেন, এক্সিম ব্যাংক তাদের ওপর প্রভাব বিস্তার করবে, এতে বৈষম্য তৈরি হতে পারে।

পদ্মা ব্যাংকের একাধিক কর্মকর্তা জানান, তাদের ক্ষেত্রে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়া যেতে পারে। অনেকেই নানা শঙ্কায় আছেন। অনেকেই অন্য কোথাও চেষ্টা করছেন। একই শঙ্কা দেখা দিয়েছে রাষ্ট্র মালিকানাধীন বিডিবিএল ব্যাংকের কর্মীদের মধ্যেও।

বিডিবিএলের একাধিক কর্মকর্তা জানান, ভালো পারফরম্যান্সের কারণে তাদের ব্যাংকে হয়তো অনেকেরই দ্রুত প্রমোশন হয়েছে, কিন্তু সোনালী ব্যাংকের অনেকেই হয়তো প্রমোশনই পাননি। সেক্ষেত্রে সোনালী ব্যাংক অধিগ্রহণ করলে বিডিবিএলের কাজের পরিবেশ ভালো থাকবে কি না, তা নিয়েও সংশয়ে তারা।

কর্মকর্তারা বলছেন, কাজের পরিবেশ যা-ই হোক, একীভূতকরণের বিষয়টি দ্রুতই সমাধান হওয়া প্রয়োজন। যদি একীভূত হয় তবে তা দ্রুত করা হোক, আর একীভূত না হলেও সেটির সিদ্ধান্তও দ্রুত জানানো হোক। একীভূতকরণের প্রক্রিয়াটি বর্তমানে কোন পর্যায়ে অনেক ব্যাংক কর্মীই সেটি জানেন না। অডিট নিয়োগ হলেও সেটির অগ্রগতিও জানা নেই তাদের।

বিডিবিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) হাবিবুর রহমান গাজী বলেন, ‘একীভূতকরণ প্রক্রিয়াটির এখনো কোনো অগ্রগতি নেই, এখনো এমওইউ পর্যায়েই আছি। অডিটর নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, তারা ঘুরে গেছেন। এছাড়া কিছু না।’

এমডি বলেন, ‘খেলাপি ঋণ আদায়ে আমাদের অবস্থা এখন অনেক ভালো। তারা (কেন্দ্রীয় ব্যাংক) বলেন খেলাপি ঋণ ৫ শতাংশে নামিয়ে আনতে পারলে একীভূত করা হবে না। এত অল্প সময়ে ৫ শতাংশে নামানো কঠিন, তবু আমরা চেষ্টা করছি। আমার মনে হয় একীভূত করলে তা দ্রুত সময়ের মধ্যে করা উচিত। এখানে আমাদের দোটানায় রাখা ঠিক নয়। কারণ, ঋণগ্রহীতাসহ সবাইকে নিয়ে বড় ধরনের সমস্যায় আছি।’

ব্যাংক একীভূত নিয়ে আইএমএফের সাবেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘কোনো অচল ব্যাংকে টাকা ছাপিয়ে সচল করার প্রয়োজন নেই। তথ্যভিত্তিকভাবে, যাচাই-বাছাই করে একীভূতকরণের উদ্যোগ নিলে সেটা নিশ্চয় খাতের জন্য ভালো হয়। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক তড়িঘড়ি করে যেভাবে ব্যাংক একীভূত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সেটা তথ্যভিত্তিক ছিল না, শক্তিশালী ছিল না। এ কারণে আস্থার সংকট তৈরি হয়। এখন আর এ নিয়ে কথা আসছে না, পিছু হটেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।’

যা বললেন সাবেক গভর্নররা
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন বলেন, ‘ব্যাংক একীভূত বা মার্জ করে ব্যাংকের সংখ্যা কমানো যায়, এটি অন্য অনেক দেশেও হয়। তবে জোর করে একীভূত করা ঠিক হবে না। আলাপ-আলোচনা হতে হবে, যেসব ব্যাংক একীভূত করা হবে তাদের সম্মতি থাকতে হবে।’

ব্যাংকগুলোর একীভূতকরণ বিষয়ে জানতে চাইলে আরেক সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘প্রয়োজনের তুলনায় আমাদের ব্যাংকের সংখ্যা বেশি। এ সংখ্যা বাড়তে বাড়তে ৬১টিতে পৌঁছেছে। রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে অনুমোদন পাওয়া ব্যাংক ভালো করছে না। আবার পদ্মা ব্যাংকের মতো ব্যাংকগুলোকে নাম বদলে একীভূতকরণের নামে ভালো করার চেষ্টা না করে অবসায়ন করা ভালো ছিল।’

 

নিউজটি শেয়ার করুন

 

আপনার মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার ইমেইল এবং অন্যান্য তথ্য সংরক্ষন করুন

আপলোডকারীর তথ্য

 

ট্যাগস :

 

 

সহসাই হচ্ছে না ব্যাংক একীভূতকরণ

আপডেট সময় : ১২:১৫:৩৬ অপরাহ্ন, রবিবার, ১৪ জুলাই ২০২৪

 

দীর্ঘদিন ধরেই নানা সমস্যায় ধুঁকছে দেশের ব্যাংক ও আর্থিক খাত। অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা আর খেলাপি ঋণের চাপে বেকায়দায় অনেক প্রতিষ্ঠান। ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর অবস্থা খুবই নাজুক। ফলে একদিকে যেমন দিন দিন আমানত কমছে, অন্যদিকে আমানতকারীও হারাতে শুরু করেছে এসব খাত।

এ অবস্থায় নিজেদের অবস্থান ধরে রাখতে পারছে না অনেক ব্যাংক। তারল্য পরিস্থিতি যেমন খারাপ, আবার এসব ব্যাংককে চলতে হচ্ছে অন্য ব্যাংক থেকে ধার নিয়ে। একীভূতকরণ হলে অধিগ্রহণকারী ব্যাংকের মাধ্যমে ছাঁটাইয়ের কবলে পড়ার শঙ্কায় আছেন দুর্বল ব্যাংকের কর্মীরা।

দুর্বল ব্যাংক একীভূতকরণের সিদ্ধান্ত
ব্যাংকখাতে গতি ও স্থিতিশীলতা ফেরাতে দুর্বল ব্যাংকগুলোকে অন্য ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করার সিদ্ধান্ত হয়। এরই অংশ হিসেবে চারটি ব্যাংকের মধ্যে সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) সই হয়ে গেছে। তবে নিজেদের দুর্বল প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে এখনো সিদ্ধান্তহীনতায় খোদ প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মকর্তারা। তারা মনে করছেন, একীভূত করলে দ্রুতই করা উচিত, তা না হলেও সিদ্ধান্ত জানানো দরকার। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, সামগ্রিকভাবে কাজ চলমান। চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের জন্য আরও অপেক্ষা করতে হবে।

খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ব্যাংক একীভূত করার ঘোষণা ২০২৪ সালের বার্ষিক রিপোর্টের ভিত্তিতে হওয়ার কথা। ২০২৪ সালের প্রতিবেদনটি প্রকাশ হবে ২০২৫ সালের জুন মাসে। এ আর্থিক প্রতিবেদনের ওপর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের চাপিয়ে দেওয়া তড়িঘড়ি সিদ্ধান্তে বিষয়টি অনেকটাই ভেস্তে আছে।

একীভূতকরণ কতদূর
প্রতিবেদন প্রকাশ এবং সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করতে এখনো অনেক সময় অপেক্ষা করতে হবে। অন্যদিকে, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বেসিক ব্যাংককে রাষ্ট্রায়ত্ত বলে স্বীকার না করেই আলোচনার জন্ম দেয় খোদ বাংলাদেশ ব্যাংক। তড়িঘড়ি সিদ্ধান্ত আর বেসিক ব্যাংককে রাষ্ট্রীয় বলে স্বীকার না করা নিয়ে শুরু হয় সমালোচনা। এতেই অনেকটা পথ হারায় একীভূতকরণ ইস্যুটি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি সূত্র বলছে, দেশের দুর্বল ব্যাংকগুলো চলতি বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত স্বেচ্ছায় একীভূত ও অধিগ্রহণের সুযোগ দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ সময়ের মধ্যে তারা ব্যর্থ হলে ২০২৫ সালের মার্চ থেকে একীভূতকরণ ও অধিগ্রহণের উদ্যোগ নেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

এর আগে গত বছরের ডিসেম্বরে কিছু ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের আর্থিক অবস্থার অবনতির মধ্যে একীভূতকরণ ও অধিগ্রহণের দিকনির্দেশনা দিতে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রম্পট কারেকটিভ অ্যাকশন (পিসিএ) ফ্রেমওয়ার্ক নামে একটি গাইডলাইন করে। এ উদ্যোগে সঞ্চয়কারীসহ অনেকের মধ্যে উদ্বেগ দেখা দেয়।

চলতি বছরের ১৮ মার্চ ব্যাংক একীভূতকরণ প্রক্রিয়া শুরু করতে এক্সিম ব্যাংক ও পদ্মা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের মধ্যে একটি এমওইউ সই হয়। গভর্নরের উপস্থিতিতে এ চুক্তি সই অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়। এরপর গত ১৩ মে রাষ্ট্র মালিকানাধীন সোনালী ব্যাংকের সঙ্গে ‘স্বেচ্ছায় একীভূত’ হওয়ার জন্য সমঝোতা চুক্তি করে বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেড (বিডিবিএল)।

চুক্তি সইয়ের পর এখন এসব ব্যাংকের সম্পদ ও দায় পর্যালোচনা করার কথা। এরপরই নানা প্রক্রিয়া শেষে একীভূত হবে ব্যাংকগুলো। এদিকে, একীভূত হওয়ার খবরে আতঙ্ক তৈরি হয় ওইসব ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে। কারণ, নীতিমালা অনুযায়ী একীভূত হওয়ার তিন বছর পর দুর্বল ব্যাংকের কর্মীদের কর্মদক্ষতা বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নিতে পারবে অধিগ্রহণকারী ব্যাংক। এতে একীভূতকারী ব্যাংকের মাধ্যমে ছাঁটাই হওয়ার আশঙ্কায় পড়েন তারা।

কেন দেরি একীভূতকরণ প্রক্রিয়ায়
একীভূত করা নিয়ে অনেক দিন ধরে আলোচনা হলেও গত ৩১ জানুয়ারি ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীদের সঙ্গে এক বৈঠকে বাংলাদেশ ব্যাংক দুর্বল ব্যাংকগুলোকে একীভূত করার পরামর্শ দেয়। এরপর গত ১৪ মার্চ এক্সিম ব্যাংক ও পদ্মা ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ একে অপরের সঙ্গে একীভূত হওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। গত ৩ এপ্রিল সরকারি খাতের রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংককে (রাকাব) বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের সঙ্গে এবং বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংককে (বিডিবিএল) সোনালী ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করার সিদ্ধান্ত হয়। এরপর ৮ এপ্রিল বেসরকারি খাতের ভালো ব্যাংকের তালিকায় থাকা সিটি ব্যাংকের সঙ্গে সমস্যাগ্রস্ত বেসিক ব্যাংককে এবং ৯ এপ্রিল বেসরকারি ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক বা ইউসিবির সঙ্গে ন্যাশনাল ব্যাংককে একীভূত করার সিদ্ধান্ত হয়।

এরপর ১৬ এপ্রিল ‘বেসিক ব্যাংক সরকারি নয়’ বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্রের দেওয়া বক্তব্যে বিভ্রান্তি তৈরি হয়। সেই বিভ্রান্তি দূর করতে নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করে বেসিক ব্যাংক।

এ নিয়ে ব্যাখ্যায় বেসিক ব্যাংক কর্তৃপক্ষ জানায়, অন্য সরকারি ব্যাংকগুলোর মতোই বেসিক ব্যাংকও একই পরিচালন কাঠামো, নীতিমালা ও বেতন কাঠামোর আওতায় পরিচালিত হয়ে আসছে। অভিযোগ যায় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় পর্যন্ত। আরেকটি বেসরকারি ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হতে চায় না বলে আনুষ্ঠানিকভাবে সরকারকে চিঠি দিয়ে জানায় বেসিক ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ। অন্যদিকে ন্যাশনাল ব্যাংকও একীভূত হবে না বলে গত ৬ মে আনুষ্ঠানিকভাবে সংবাদ সম্মেলন করে জানায়। এরপর কচ্ছপ গতি পায় অন্য ব্যাংকগুলোর একীভূতকরণ প্রক্রিয়ায়।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও ভারপ্রাপ্ত মুখপাত্র সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘যে ব্যাংকগুলোর এমওইউ চুক্তি হয়েছে সেসব ব্যাংকে অডিট নিয়োগ করা হয়েছে। এখানে দেনা-পাওনার বিষয় আছে। অডিটর যে মেসেজগুলো করবেন তার জন্য সময় লাগবে, চাইলেই দ্রুত হবে না, একীভূতকরণের প্রসেসটা দীর্ঘ সময়ের। এখানে দুটো প্রতিষ্ঠানের অনেক ফ্যাক্টর থাকে, সেগুলো মেলাতে হয়। দেনা-পাওনা কী পরিমাণ সেগুলোও দেখতে হয়। এরপর স্কিম রেডি করা এবং কোর্টের অনুমোদন নিতে হয়।’

সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘কোনো ব্যাংককে একীভূত করতে সবশেষ হাইকোর্টের অনুমতি থাকতে হবে, কোনো পার্টির ক্লেম থাকা যাবে না। এরই মধ্যে প্রতিষ্ঠানগুলোয় অডিটর নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। পদ্মা-এক্সিম ব্যাংকের অডিটের কাজ অনেকটা এগিয়েছে। তবে দেরিতে চুক্তি হওয়ায় সোনালী-বিডিবিএলের অডিট রিপোর্ট তৈরিতে আরও কিছুটা দেরি হবে। একীভূত প্রতিষ্ঠান দুটোর স্টেকহোল্ডার যারা আছেন, সেখানেও ব্যাপক দেনা-পাওনার বিষয়সহ স্বচ্ছতা-জবাবদিহির বিষয় রয়েছে। যারা তড়িঘড়ির কথা বলছেন তারা না বুঝেই বলছেন।’

চাকরি হারানোর শঙ্কায় আতঙ্কিত কর্মীরা
বেসরকারি পদ্মা ও এক্সিম ব্যাংকের মধ্যে এমওইউ হওয়ার পরপরই চাকরি হারানোর শঙ্কা দানা বাঁধে পদ্মা ব্যাংক কর্মীদের মধ্যে। তাদের অনেকেই মনে করছেন, এক্সিম ব্যাংক তাদের ওপর প্রভাব বিস্তার করবে, এতে বৈষম্য তৈরি হতে পারে।

পদ্মা ব্যাংকের একাধিক কর্মকর্তা জানান, তাদের ক্ষেত্রে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়া যেতে পারে। অনেকেই নানা শঙ্কায় আছেন। অনেকেই অন্য কোথাও চেষ্টা করছেন। একই শঙ্কা দেখা দিয়েছে রাষ্ট্র মালিকানাধীন বিডিবিএল ব্যাংকের কর্মীদের মধ্যেও।

বিডিবিএলের একাধিক কর্মকর্তা জানান, ভালো পারফরম্যান্সের কারণে তাদের ব্যাংকে হয়তো অনেকেরই দ্রুত প্রমোশন হয়েছে, কিন্তু সোনালী ব্যাংকের অনেকেই হয়তো প্রমোশনই পাননি। সেক্ষেত্রে সোনালী ব্যাংক অধিগ্রহণ করলে বিডিবিএলের কাজের পরিবেশ ভালো থাকবে কি না, তা নিয়েও সংশয়ে তারা।

কর্মকর্তারা বলছেন, কাজের পরিবেশ যা-ই হোক, একীভূতকরণের বিষয়টি দ্রুতই সমাধান হওয়া প্রয়োজন। যদি একীভূত হয় তবে তা দ্রুত করা হোক, আর একীভূত না হলেও সেটির সিদ্ধান্তও দ্রুত জানানো হোক। একীভূতকরণের প্রক্রিয়াটি বর্তমানে কোন পর্যায়ে অনেক ব্যাংক কর্মীই সেটি জানেন না। অডিট নিয়োগ হলেও সেটির অগ্রগতিও জানা নেই তাদের।

বিডিবিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) হাবিবুর রহমান গাজী বলেন, ‘একীভূতকরণ প্রক্রিয়াটির এখনো কোনো অগ্রগতি নেই, এখনো এমওইউ পর্যায়েই আছি। অডিটর নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, তারা ঘুরে গেছেন। এছাড়া কিছু না।’

এমডি বলেন, ‘খেলাপি ঋণ আদায়ে আমাদের অবস্থা এখন অনেক ভালো। তারা (কেন্দ্রীয় ব্যাংক) বলেন খেলাপি ঋণ ৫ শতাংশে নামিয়ে আনতে পারলে একীভূত করা হবে না। এত অল্প সময়ে ৫ শতাংশে নামানো কঠিন, তবু আমরা চেষ্টা করছি। আমার মনে হয় একীভূত করলে তা দ্রুত সময়ের মধ্যে করা উচিত। এখানে আমাদের দোটানায় রাখা ঠিক নয়। কারণ, ঋণগ্রহীতাসহ সবাইকে নিয়ে বড় ধরনের সমস্যায় আছি।’

ব্যাংক একীভূত নিয়ে আইএমএফের সাবেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘কোনো অচল ব্যাংকে টাকা ছাপিয়ে সচল করার প্রয়োজন নেই। তথ্যভিত্তিকভাবে, যাচাই-বাছাই করে একীভূতকরণের উদ্যোগ নিলে সেটা নিশ্চয় খাতের জন্য ভালো হয়। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক তড়িঘড়ি করে যেভাবে ব্যাংক একীভূত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সেটা তথ্যভিত্তিক ছিল না, শক্তিশালী ছিল না। এ কারণে আস্থার সংকট তৈরি হয়। এখন আর এ নিয়ে কথা আসছে না, পিছু হটেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।’

যা বললেন সাবেক গভর্নররা
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন বলেন, ‘ব্যাংক একীভূত বা মার্জ করে ব্যাংকের সংখ্যা কমানো যায়, এটি অন্য অনেক দেশেও হয়। তবে জোর করে একীভূত করা ঠিক হবে না। আলাপ-আলোচনা হতে হবে, যেসব ব্যাংক একীভূত করা হবে তাদের সম্মতি থাকতে হবে।’

ব্যাংকগুলোর একীভূতকরণ বিষয়ে জানতে চাইলে আরেক সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘প্রয়োজনের তুলনায় আমাদের ব্যাংকের সংখ্যা বেশি। এ সংখ্যা বাড়তে বাড়তে ৬১টিতে পৌঁছেছে। রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে অনুমোদন পাওয়া ব্যাংক ভালো করছে না। আবার পদ্মা ব্যাংকের মতো ব্যাংকগুলোকে নাম বদলে একীভূতকরণের নামে ভালো করার চেষ্টা না করে অবসায়ন করা ভালো ছিল।’