রাজধানীতে অপর্যাপ্ত নালা-নর্দমা, যা আছে তাও বন্ধ আবর্জনায়
- আপডেট সময় : ০৯:২৯:৩৬ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ১৫ জুলাই ২০২৪
- / 56
রাজধানীর জলাবদ্ধতা যেন নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই জলাবদ্ধতার স্থায়িত্ব নির্ভর করছে বৃষ্টির পরিমাণের ওপর। ভারি বৃষ্টি হলে রাজধানীবাসীকে বেশি সময় ধরে ভোগান্তি পোহাতে হয়, আর একটু কম হলে কিছুটা রক্ষা।
কথা ছিল ভারি বৃষ্টি হলে পানি দ্রুত সরে যাবে ড্রেন হয়ে নালা-নর্দমা দিয়ে খাল ও নদীতে। কিন্তু সেটি হচ্ছে না। ফলে জলাবদ্ধতার দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে রাজধানীবাসীকে।
অপর্যাপ্ত নালা-নর্দমাও বন্ধ আবর্জনায়বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই পরিস্থিতির প্রধান কারণ দ্রুত খাল ও নদীতে পানি সরে যেতে যে পরিমাণ নালা-নর্দমার প্রয়োজন তা না থাকা। ফলে বৃষ্টির পানি দ্রুত সরিয়ে নেওয়া যাচ্ছে না।
রাজধানীতে প্রয়োজনের তুলনায় অর্ধেকেরও কম নালা-নর্দমা রয়েছে। এসব নালা-নর্দমার বেশির ভাগ আবার রাজধানীবাসীর অসচেতনতায় বন্ধ থাকে। যেসব সড়কে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হচ্ছে, দেখা গেছে সেসব সড়কের ক্যাচপিটগুলো ময়লা-আবর্জনা ফেলে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ফলে দ্রুত পানি সরে যেতে পারছে না।
আবার ড্রেনে পানি প্রবেশ করতে পারলেও সেখানে বাসিন্দাদের ফেলা পলিথিন, নির্মীয়মাণ ভবনের বালু ও কংক্রিট, বাসাবাড়ির ছোট-বড় বর্জ্যে ভরে আছে। এ কারণে রাজধানীতে যে পরিমাণ ড্রেন, নালা-নর্দমা রয়েছে সেগুলোর সঠিক ফল পাওয়া যাচ্ছে না। আবার দেশব্যাপী অতিবৃষ্টির কারণে নদীর পানি বাড়লে রাজধানীর চারপাশের নদীর পানিও বাড়ে। এতে ভোগান্তি আরো বাড়ে।
সূত্র জানায়, গত শুক্রবারের ভারি বৃষ্টির পর জলাবদ্ধতা শুরুর সময় থেকে গতকাল শনিবার দুপুর পর্যন্ত ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন এলাকায় জমে থাকা পানির শতাধিক স্পট থেকে ৩০০ টন এবং দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকার দেড় শতাধিক স্পট থেকে ৬১৫ টন ময়লা-আবর্জনা অপসারণ করা হয়েছে।
এসব ময়লা-আবর্জনার বেশির ভাগ ভাসমান। বৃষ্টির পানির স্রোতে পানি অপসারণের বিভিন্ন স্থানে এসব ময়লা-আবর্জনা গিয়ে আটকা পড়ে। দক্ষিণ সিটির কমলাপুরের টিটিপাড়া ও ধোলাইখাল পাম্প স্টেশনে ছোট-বড় সাতটি পাম্প পানি নিষ্কাশনের কাজ করেছে। এই দুটি পাম্প স্টেশনের মাধ্যমে গত শুক্রবার সকাল সাড়ে ৬টা থেকে গতকাল শনিবার দুপুর ১২টা পর্যন্ত ১৪৩ কোটি ৫৫ লাখ লিটার পানি অপসারণ করা হয়েছে।
জলাবদ্ধতা এবং নিজেদের কার্যক্রম সম্পর্কে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা ক্যাপ্টেন মোহাম্মদ ফিদা হাসান বলেন, ‘প্রয়োজনের তুলনায় আমাদের পানি ব্যবস্থাপনার অবকাঠামো অপর্যাপ্ত। নালা-নর্দমা যা প্রয়োজন তার মাত্র অর্ধেক আছে। আবার যা আছে তা-ও রাজধানীবাসীর অসচেতনতায় পরিপূর্ণভাবে ব্যবহার করা যাচ্ছে না। রাস্তার পাশে থাকা ড্রেনগুলো প্লাস্টিকের বর্জ্যে ভরে যায়। নিয়মিত পরিষ্কার করেও এ থেকে রক্ষা মিলছে না। বৃষ্টির পানি দ্রুত সরে যেতে রাজধানীতে যেসব ড্রেন রয়েছে সেগুলো বাসিন্দাদের ফেলা প্লাস্টিক বর্জ্য, নুড়ি পাথর, বালুসহ অন্য ময়লায় বন্ধ হয়ে যায়।’
তিনি বলেন, ‘ড্রেনের ওপর রাখা হয় নির্মাণসামগ্রী। বালু রাখলে বৃষ্টির পানিতে বালু গিয়ে ড্রেনে প্রবেশ করছে। এ ছাড়া নির্মাণকাজের বিভিন্ন ধরনের আবর্জনা ফেলেও নালা-নর্দমা বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। আবার ড্রেন থেকে যে পানি নালা-নর্দমা হয়ে খালে বা নদীতে যাবে সে জায়গাও নেই। খালগুলো ভরাট করে স্থাপনা পর্যন্ত তোলা হয়েছে। কোথাও কোথাও এখন আর খালের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না। এসব কারণে অনেক চেষ্টা করেও দ্রুত রাজধানীর জলাবদ্ধতা কমানো যাচ্ছে না। আমরা চিহ্নিত করার চেষ্টা করছি, কোথায় কী কারণে ড্রেনের লাইন আটকে গেল, খালের পানি কেন যেতে পারছে না, কোথায় কী প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়েছে। এসব তথ্য সংগ্রহ করে আমরা অভিযান চালাব। যেখানে যা-ই থাকুক, কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। সব কিছু উচ্ছেদ করা হবে।’
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা মোহাম্মদ নাসিম আহমেদ বলেন, ‘কম সময়ে ১৩০ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। আর বৃষ্টি অব্যাহত থাকায় জলাবদ্ধতা দীর্ঘ হওয়ার একটি কারণ। আরেকটি বড় কারণ হচ্ছে নর্দমাগুলোর ৫০ ফুট অন্তর অন্তর যে ক্যাচপিট রয়েছে সেগুলো ঠিকমতো পানি নিষ্কাশন করতে পারছে না।
নগরবাসী অভ্যাসগত কারণে যত্রতত্র পলিথিন ও প্লাস্টিকজাতীয় বর্জ্য ফেলছে। বৃষ্টি হলে সেগুলো ক্যাচপিটে গিয়ে জমা হচ্ছে। আমরা একদিকে পরিষ্কার করছি তো আবার অন্যদিকে সেগুলো আটকে যাচ্ছে। ফলে পানি সরতে দেরি হয়েছে। আর পানি সরতে বিলম্ব হলেই স্বাভাবিকভাবেই জলাবদ্ধতা তৈরি হয়। জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তি পেতে নগরবাসীর সচেতনতার বিকল্প নেই।’
তিনি বলেন, ‘পানি সরে যাওয়ার জন্য স্লুইস গেটগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের ৫৫টি স্লুইস গেটের মধ্যে ৩৭টি বেড়িবাঁধসংলগ্ন, বাকি ১৮টি কামরাঙ্গীর চরে। আমরা সব স্লুইস গেট সচল করেছি। কিন্তু সারা দেশে অতিবৃষ্টি হওয়ায় ঢাকা শহর ঘিরে চারপাশের যে নদ-নদী রয়েছে সেগুলোর পানির স্তর বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে স্লুইস গেট দিয়ে সক্ষমতা অনুযায়ী পানি নিষ্কাশন করা সম্ভব হচ্ছে না। এটিও পানি সরতে বিলম্ব হওয়ার আরেকটি কারণ।’
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক এবং ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইপিডি) নির্বাহী পরিচালক আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, ‘শহরের মোট ভূমির অন্তত ১২ শতাংশ জলাধার থাকা প্রয়োজন, সেখানে রাজধানীতে আছে মাত্র ২ শতাংশ। ফলে বৃষ্টির পানি ধরে রাখার জায়গাও নেই।
আবার বৃষ্টির পানি কোন পথ দিয়ে নদীতে নামবে, সেদিকেও নজর দিতে হবে। প্রথমে পানি নামানোর জায়গা তো চাই! পানি নামানোর ব্যবস্থা না করে বিচ্ছিন্নভাবে কাজ করলে তাতে শুধু টাকার অপচয় হবে। আমাদের পর্যাপ্ত নালা-নর্দমা নিশ্চিত করতে হবে। একই সঙ্গে রাজধানীবাসীকে সচেতন হতে হবে। যত্রতত্র ময়লা ফেলা বন্ধ করতে হবে।’
নিউজটি শেয়ার করুন