সড়ক এখন মরণফাঁদ
ঝালকাঠিতে ১৪ জনসহ একদিনে প্রাণ গেল ২৩ জনের
- আপডেট সময় : ০৯:১৬:২৮ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ৪৭ বার পড়া হয়েছে
দেশের বিভিন্ন সড়ক-মহাসড়ক যেন মৃত্যুর মিছিল। প্রতিদিনই ঝরছে তাজা প্রাণ। ফরিদপুরে ১৩ জনের প্রাণহানির ঘটনা ২৪ ঘণ্টা না পেরুতেই ঝালকাঠিতে বেপরোয়া ট্রাকের চাপায় ১৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। একটি সিমেন্টবাহী ট্রাক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে সামনে থাকা ৩টি ইজিবাইক ও প্রাইভেট কারকে চাপা দিলে এই প্রাণহানির ঘটনা ঘটে।
এদিকে গত ২৪ ঘণ্টায় দেশের বিভিন্ন জেলায় সড়ক দুর্ঘটনায় আরও ৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে সাভারে বেপরোয়া ট্রাক চাপায় ৩ জন, নওগাঁয় দম্পতি, ফেনীতে ২ জন, রাজবাড়ীতে ১ জন ও সরিষাবাড়ীতে ১ জন রয়েছে। এছাড়া গত মার্চে সড়কে ৫৫০ জনের প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। বিস্তারিত প্রতিনিধিদের পাঠানো রিপোর্টে-
ঝালকাঠি প্রতিনিধি জানান, ঝালকাঠির সদর উপজেলায় একটি ব্রেকফেল ট্রাক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে তিনটি অটোরিকশা ও একটি মাইক্রোবাসকে চাপা দিলে অন্তত ১৪ জন নিহত হয়েছেন। এই দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন আরও কয়েকজন। বুধবার দুপুর ২টার দিকে বরিশাল-পিরোজপুর আঞ্চলিক মহাসড়কের ঝালকাঠি জেলার গাবখান সেতু এলাকায় এ দুর্ঘটনা ঘটে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, টোল প্লাজায় টাকা দেয়ার অপেক্ষায় ছিল ইজিবাইক, প্রাইভেট কারসহ বেশ কয়েকটি গাড়ি।
ট্রাকটি সামনে থাকা সব গাড়িকে চাপা দিয়ে প্রতিবন্ধক ভেঙে রাস্তার পাশে চলে যায়। টোল প্লাজায় কর্মরত আল আমিন বলেন, দুপুর দেড়টার দিকে আমি টোলের টাকা কাউন্টারে দিচ্ছিলাম। হঠাৎ শব্দ শুনে পেছনে তাকিয়ে দেখি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে একটি ট্রাকটি তিনটি অটোরিকশাকে ধাক্কা দিয়ে সামনের দিকে নিয়ে গেছে। সামনে একটা মাইক্রোবাস ছিল। ওই মাইক্রোবাসের সামনে ছিল আরেকটি মিনিট্রাক। ট্রাকটি মাইক্রোবাসে ধাক্কা দিয়ে দুমড়ে-মুচড়ে ফেলে গিয়ে মিনিট্রাকটিকে ধাক্কা দেয়। মাইক্রোবাসে যে কয়জন ছিলেন, তারা সবাই ঘটনাস্থলেই মারা যান। অটোরিকশা তিনটিও দুমড়ে-মুচড়ে গেছে। অটোরিকশার যাত্রী-চালকও নিহতদের মধ্যে রয়েছেন।
নিহত ১৪ জনের মধ্যে ৬ জনের পরিচয় পাওয়া গেছে। তাঁরা হলেন- ঝালকাঠি সদরের গাবখান এলাকার নজরুল (৩৫), ওস্তা খান গ্রামের শফিকুল মাঝি (৫০), নওপাড়া গ্রামের আতিকুর রহমান (১১) ও ইমরান হোসেন (৪০), কাঁঠালিয়া উপজেলার তালগাছিয়া গ্রামের ইব্রাহিমের মেয়ে নুরজাহান (৭) ও প্রাইভেট কারের চালক ইব্রাহিম (৪০)।
ট্রাকের চালক ও সহকারী গ্রেপ্তার: ঝালকাঠিতে ১৪ জনের মৃত্যুর ঘটনায় ট্রাকের চালক ও সহকারীকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। বুধবার দুপুরে ঘটনার পর পরেই চালক ও তার সহকারীকে গ্রেপ্তার করা হয় বলে জানান ঝালকাঠির পুলিশ সুপার আফরুজুল হক টুটুল। গ্রেপ্তার চালকের নাম আল আমিন হাওলাদার। তার বাড়ি ঝালকাঠি সদরের নবগ্রামে। আর সহকারী নাজমুল শেখ খুলনা সদরের বাসিন্দা। পুলিশ সুপার বলেন, আল আমিন নিয়মিত চালক ছিলেন না। তিনি বদলি চালক হিসেবে গাড়ি চালাচ্ছিলেন। তিনি খুলনা থেকে সিমেন্টের বস্তা নিয়ে নিজ বাড়ি যাচ্ছিলেন।
তদন্ত কমিটি: এদিকে ঝালকাঠিতে ১৪ জনের মৃত্যুর ঘটনা তদন্ত কমিটি গঠন করেছে জেলা প্রশাসন। বুধবার দুপুরে দুর্ঘটনার পর পরই অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক সার্বিক রুহুল আমীনকে প্রধান করে চার সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয় বলে জানিয়েছেন জেলা প্রশাসক ফারাহ্ গুল নিঝুম। কমিটিকে তিন কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। জেলা প্রশাসক বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে নিহত ১৪ জনের পরিবারকে মোট ৫ লাখ টাকা এবং আহতদের চিকিৎসার জন্য জনপ্রতি ৫০ হাজার টাকা দেওয়া হবে।
সাভার থেকে জানান, আশুলিয়ায় পৃথক সড়ক দুর্ঘটনায় পোশাক শ্রমিক দম্পতি ও এক মোটরসাইকেল আরোহী মারা গেছেন। মঙ্গলবার দিবাগত রাতে আশুলিয়ার বিশমাইল-জিরাবো সড়কের বড় রাঙ্গামাটিয়া এলাকার ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালসের সামনে এবং সাভারের সিঅ্যান্ডবি-আশুলিয়া সড়কের দোসাইদ এলাকায় পৃথক এ দুর্ঘটনা ঘটেছে বলে নিশ্চিত করেছেন আশুলিয়া থানার পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) মো. মাসুদুর রহমান।
নিহত পোশাক শ্রমিক দম্পতিরা হলেন নাটোর জেলার সিংড়া থানার পুঁতিমারা গ্রামের আব্দুর রহমানের ছেলে দেলোয়ার হোসেন (৩২) ও তার স্ত্রী হাসি বেগম (২৮)। হাসি বেগমের বাড়িও পুঁতিমারা গ্রামে। নিহত দেলোয়ার হোসেন আশুলিয়ার পুকুরপাড় বাগানবাড়ি এলাকায় ভাড়া বাসায় থেকে স্থানীয় রাতুল নিটওয়্যার লিমিটেড নামক তৈরী পোশাক কারখানায় লাইন চিফ পদে চাকরি করতেন এবং তাঁর স্ত্রী গৃহিণী ছিলেন। তাদের দুটি কন্যাসন্তান রয়েছে।
থানা পুলিশ জানায়, ঈদের ছুটি শেষে মঙ্গলবার রাতে গ্রামের বাড়ি নাটোর থেকে কর্মস্থল আশুলিয়ার জিরাবো এলাকায় ফিরছিলেন নিহত পোশাক শ্রমিক দম্পতি। তারা বাস থেকে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের বিশমাইল এলাকায় নেমে ইজিবাইকযোগে জিরাবর যাওয়ার পথে বড় রাঙ্গামাটিয়া এলাকার ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালসের সামনে পৌঁছালে পেছন থেকে আসা দ্রুত গতির একটি ট্রাক তাদেরকে চাপা দেয়। এসময় স্থানীয়রা গুরুতর আহত ওই দম্পতিকে জিরাব পিএমকে হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাদের মৃত ঘোষণা করেন। অন্যদিকে সিঅ্যান্ডবি-আশুলিয়া সড়কের দোসাইদ এলাকায় রাত ৯টার দিকে সড়ক দুর্ঘটনায় এক মোটরসাইকেল আরোহীর মারা গেছে।
নওগাঁ প্রতিনিধি জানান, নওগাঁ থেকে মোটরসাইকেলে স্ত্রীকে নিয়ে বগুড়ায় কর্মস্থলে যাওয়ার পথে দুই মোটরসাইকেলের মুখোমুখি সংঘর্ষে প্রাণ হারিয়েছেন এক দম্পতি। এ দুর্ঘটনায় ওই দম্পতির পাঁচ বছর বয়সী ছেলে জুনাইদ ইসলাম এবং অপর মোটরসাইকেল চালক সিরাজুল ইসলাম (৫০) আহত হয়েছেন। গতকাল সকাল সাড়ে ১১টার দিকে নওগাঁ সদরের সাহাপুর এলাকায় দুর্ঘটনাটি ঘটে।
নিহতরা হলেন- জয়পুরহাটের আক্কেলপুর উপজেলার রাইকালি গ্রামের আকরামের ছেলে আনসার সদস্য এনামুল হক (৪০) ও তার স্ত্রী মোসাম্মৎ বৃষ্টি খাতুন (৩২)। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন জেলা আনসার ভিডিপি’র বগুড়া কার্যালয়ের কমান্ড্যান্ট শেখ ফিরোজ আহম্মেদ। নওগাঁ ফায়ার সার্ভিস সিভিল স্টেশন উপ-সহকারী পরিচালক মো. মাহমুদুল হাসান বলেন, সন্তানসহ স্বামী-স্ত্রী মোটরসাইকেলযোগে নওগাঁ থেকে বগুড়ার দিকে যাচ্ছিলেন। এসময় ঘটনাস্থলে মোটরসাইকেলটি পৌঁছালে বিপরীত দিক থেকে আসা দ্রুতগতির আরেকটি মোটরসাইকেল নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে তাদের ধাক্কা দেয়। এতে তারা সড়কের উপর ছিটকে পড়ে গেলে পেছন থেকে আসা একটি পিকআপভ্যান তাদের চাপা দেয়। এতে ঘটনাস্থলেই স্বামী-স্ত্রী মারা যান।
ফেনী প্রতিনিধি জানান, ফেনীতে পৃথক সড়ক দুর্ঘটনায় এক কিশোর ও এক যুবক নিহত হয়েছে। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় ফেনীর ছাগলনাইয়ায় মাইক্রোবাসের ধাক্কায় মোটরসাইকেল আরোহী আবদুল্লাহ আল নোমান পাটোয়ারী (১৭) নামের এক কিশোর নিহত হয়েছে। উপজেলার রাধানগর ইউনিয়নের নিজপানুয়া এলাকার ছাগলনাইয়া-মুহুরীগঞ্জ আঞ্চলিক সড়কের পানুয়াঘাট রাস্তার মোড়ে এ দুর্ঘটনা ঘটে বলে জানান ছাগলনাইয়া থানার ওসি হাসান ইমাম। অপরদিকে একই সময়ে ফেনী-নোয়াখালী মহাসড়কের ফেনী সদর উপজেলার কাশিমপুর স্টার লাইন ফ্ডুপ্রোডাক্টস কারখানার সামনে দূতগতির গাড়ি চাপায় ইসমাইল হোসেন (২২) নামের এক পথচারী যুবক নিহত হয়েছেন বলে জানিয়েছেন মহিপাল হাইওয়ে থানার পরিদর্শক মোস্তফা কামাল।
নিহত নোমান ফেনী শহরের শান্তি কোম্পানি এলাকার পাটোয়ারী বাড়ির আলমগীর পাটোয়ারীর ছেলে। তিনি কোরআনে হাফেজ ছিলেন। অপরজন নিহত ইসমাইল হোসেন ফেনীর দাগনভূঞা উপজেলার জয়লস্কর ইউনিয়নের মনির হোসেনের ছেলে।
সরিষাবাড়ী (জামালপুর) প্রতিনিধি জানান, সরিষাবাড়ীতে রাস্তা পার হতে গিয়ে মাইক্রোবাস চাপায় হারুনুর রশিদ (৪০) নামে এক ক্যাবল অপারেটর ব্যবসায়ীর মৃত্যু হয়েছে। মঙ্গলবার রাত পৌনে ১১টার দিকে উপজেলার পিংনা ইউনিয়নের কাওয়ামারা বটতলা এলাকার তারাকান্দি-ভুয়াপুর সড়কে এ দুর্ঘটনা ঘটে। হারুনুর রশিদ কাওয়ামারা (পশ্চিমপাড়া) গ্রামের মজিবুর রহমানের ছেলে। তিনি দুই কন্যার জনক ছিলেন। বাড়ি পাশে তিনি মুদি দোকান ও ক্যাবল অপারেটরের ব্যবসা করতেন। তিনি বাড়ির পাশে সড়ক পার হচ্ছিলেন। এ সময় ঢাকা থেকে তারাকান্দিগামী একটি মাইক্রোবাস তাকে চাপা দেয়। স্থানীয়রা তাকে উদ্ধার করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।
রাজবাড়ী প্রতিনিধি জানান, রাজবাড়ীতে দাঁড়িয়ে থাকা পাটবোঝাই ট্রাকে গ্যাস বহনকারী আরেকটি ট্রাক ধাক্কায় চালকের এক সহকারী নিহত হয়েছেন। রাজবাড়ী শহরের আহম্মদ আলী মৃধা কলেজ এলাকায় রাজবাড়ী-কুষ্টিয়া আঞ্চলিক মহাসড়কে মঙ্গলবার রাত সাড়ে ১২টার দিকে এ ঘটনা ঘটে। নিহত দিলীপ শিকদার যশোর জেলার বাঘারপাড়া উপজেলার আন্দুল বাড়িয়া গ্রামের রনজিৎ শিকদারের ছেলে।