শান্ত যাত্রাবাড়ী : ধরপাকড় আতঙ্ক
- আপডেট সময় : ০৪:০৩:০৩ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৬ জুলাই ২০২৪
- / 56
চারিদিকে তীব্র রোদের ছটা, আকাশে হালকা সাদা মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে। এলোমেলো হাওয়ায় দুলছে চারপাশের গাছপালা। এর মাঝে মহাসড়ক ধরে স্বাভাবিক গতিতে চলছে ছোট-বড় যানবাহন। এটিই এখন স্থানীয়দের কাছে শান্ত ও শান্তিময় পরিস্থিতি। বলছিলাম, শুক্রবার সকালে যাত্রাবাড়ী, রায়েরবাগ, শনির আখড়া, কাজলার ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের অবস্থার কথা।
তুমুল ঝড়ের পরের প্রশান্তির আবেশ যেন চারপাশে। পাঁচ-ছয়দিন আগেও যে জায়গাটা ছিল বিক্ষোভে উত্তাল। সংঘাত-সহিংসতার আগুন যেন পুড়িয়ে দিচ্ছিল সবকিছু। সেখানকার মানুষের কাছে এখন এমন শান্ত অবস্থা সীমাহীন প্রশান্তির হবে, এটাই স্বাভাবিক। তবে ঝড় কেটে গেলেও চিহ্ন থেকে যায়। তাই সচেতনভাবে দেখলে যাত্রাবাড়ী এলাকার ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক ও এর আশেপাশের এলাকায় চোখে পড়ে সংঘাত-ধ্বংসের চিহ্ন। সেই সংঘাতের চিহ্ন বুকে নিয়েই এখন শান্ত যাত্রাবাড়ীর রায়েরবাগ, শনির আখড়া, কাজলা।
স্থানীয়রা জানিয়েছেন, ‘পরিস্থিতি শান্ত হওয়ার পর ধরপাকড় চালাচ্ছে পুলিশ। রাতে চালানো হচ্ছে অভিযান। রাতে চলাচলের ক্ষেত্রে কাউকে সন্দেহ হলে ধরে নিয়ে যাচ্ছে পুলিশ। তাই আতঙ্কে রয়েছেন তারা।’
শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে অগ্নিগর্ভ ছিল যাত্রাবাড়ীর ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের এই অংশটি। ১৭ থেকে ২১ জুলাই বিকেল পর্যন্ত এই অংশটি ছিল আন্দোলনকারীদের দখলে। এ সময়ে এ মহাসড়ক জুড়ে চলে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ। সংঘাত-সংঘর্ষে হতাহতও দেশের যেকোনো স্থান থেকে এ এলাকাটিতে বেশি বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
মহাসড়কের দক্ষিণ পাশে রায়েরবাগ বাসস্ট্যান্ড থেকে একটি সড়ক চলে গেছে মেরাজনগর-মোহাম্মদবাগের দিকে। এ সড়কটি ধরে কিছুটা এগিয়ে দুটি বাঁকের পর আরও কিছুটা এগিয়ে কদমতলী থানা। গত শুক্রবার এই থানাটির নিয়ন্ত্রণ নিতে মরিয়া ছিল বিক্ষুব্ধরা। পুলিশও প্রতিরোধ গড়ে তুললে রণক্ষেত্রে পরিণত হয় পুরো এলাকাটি। ব্যাপক হতাহতের ঘটনা ঘটে। এ গলির বিভিন্ন স্থাপনায় এখনো ধোঁয়ার কালো চিহ্ন। আন্দোলনকারীরা বিভিন্ন জায়গায় আগুন ধরিয়ে রেখেছিল সেদিন। আজ অটোরিকশার আনাগোনায় এ গলিটি মুখর, এর মাঝেই প্রশান্তি দেখছেন স্থানীয়রা।
রায়েরবাগ বাসস্ট্যান্ডের একজন দোকানদার নাম প্রকাশ না করে বলেন, ‘আমরা গত সপ্তাহের বৃহস্পতিবার থেকে দোকানপাট বন্ধ রেখেছিলাম। এমন পরিস্থিতি জীবনে দেখিনি। এখানে অনেক মানুষ আহত ও নিহত হয়েছেন। পুলিশও মারা গেছেন। দুজন পুলিশকে মেরে ওভারব্রিজের ওপর ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল। পরে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে পুলিশের অভিযানেও অনেকে আহত ও নিহত হয়েছেন। তবে এখন পরিস্থিতি শান্ত। আমরা আর বিশৃঙ্খলা চাই না।’
শুক্রবার সকালে গিয়ে রায়েরবাগ বাসস্ট্যান্ড যাত্রী ছাউনিতে পুলিশ সদস্যদের অবস্থান করতে দেখা গেছে।
শনির আখড়ায় দনিয়া কলেজের সামনে অবস্থান নিয়েছে সেনাবাহিনীর সদস্যরা। শনির আখড়া ও কাজলায় ওভার ব্রিজের উত্তর পাশে পুলিশ ও এপিবিএন সদস্যদের দেখা গেছে।
গত ১৭ ও ১৮ জুলাই বিক্ষুদ্ধরা কাজলা এলাকায় মেয়র মোহাম্মদ হানিফ ফ্লাইওভারের দুটি টোল প্লাজাই একেবারে ধ্বংস করে দিয়েছিল। আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ফেলার পর টোল নেওয়ার বুথগুলোর খাঁচা পড়েছিল। লুটপাট হয়েছিল টোল প্লাজার জিনিসপত্র।
শুক্রবার গিয়ে দেখা গেছে, পশ্চিম পাশের টোল প্লাজায় ম্যানুয়ালি (কাগজে লিখে) টোল নেওয়া হচ্ছে। টোল নেওয়ার ডিজিটাল সিস্টেমটি স্থাপন করতে আরও অনেক দিন সময় লাগবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
পূর্ব পাশের টোল প্লাজার বুথগুলো মেরামত করতে দেখা গেছে। এখানে কর্মরত ইলেকট্রিশিয়ান মো. আবির হোসেন বলেন, পুড়ে যাওয়া সব কিছু সরিয়ে বুথগুলোর কাঠামো তৈরি করা হচ্ছে। তারপর আপাতত এখানেও হাতে টোল আদায় করা হবে। পুরো সিস্টেমটি ফ্রান্স থেকে আসবে। এতে কয়েক মাস সময় লাগতে পারে। দুটি টোল প্লাজায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা মোতায়েন রয়েছেন।
এ মহাসড়কের বিভিন্ন স্থানের সড়ক বিভাজকের উপরে লোহার বেড়াগুলো ওই সময় অনেকেই খুলে নিয়ে গেছে। সড়ক বিভাজকের কংক্রিটের খণ্ডগুলোও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সেগুলো নির্ধারিত জায়গা থেকে সরিয়ে ফেলা হয়েছিল। পরিস্থিতি শান্ত হলে সড়ক বিভাগের লোকজন সড়ক বিভাজকগুলো যথাস্থানে বসিয়ে দিয়েছে। অনেকগুলোই ভেঙেচুরে গেছে।
কাজলা ওভার ব্রিজ কালো ধোঁয়ায় এখনো মলিন। সড়কের যে জায়গাগুলোতে আগুন জ্বালানো হয়েছিল সেখানকার পিচগুলো বিকৃত হয়ে আছে এখনো। যদিও পুড়িয়ে দেওয়া বাসগুলো এরই মধ্যে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।
আন্দোলনকারীদের সরিয়ে বন্ধ থাকা মহাসড়ক খুলে দিতে গত শনিবার বিকেল থেকে এ এলাকায় অভিযান শুরু করে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। সোমবার থেকে মোটামুটি স্বাভাবিক হয় এই এলাকা।
রায়েরবাগ, শনির আখড়া ও কাজলা এলাকার বাসিন্দারা জানিয়েছেন, ‘অভিযানের সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ব্যাপকভাবে টিয়ারশেল নিক্ষেপ, রাবার বুলেট ছাড়াও গুলি বর্ষণ করে। এতে অনেক মানুষ হতাহত হয়। তবে হতাহতের কোনো পরিসংখ্যান কারও কাছেই নেই।’
রায়েরবাগ ও শনির আখড়ার ইন্টারনেট ও ডিস সংযোগের বিভিন্ন পোলে গুলির চিহ্ন দেখা গেছে। শনির আখড়ার আন্ডারপাসের উত্তর পাশে কয়েকজন দোকানদার নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘গত রোববার এখানে পুলিশের গুলিতে কয়েকজন মারা গেছেন। আন্ডারপাসের ওপর থেকে গুলি চালিয়েছিল পুলিশ। ৩-৪ জন স্পটেই মারা যান। হাজী গলির মুখেই তারা একটি লোহার পোলে গুলির চিহ্ন দেখান।’
এখানকার ফুটপাতের একজন মসলা বিক্রেতা বলেন, ‘গুলির আঘাতে আমার দোকানের অনেকগুলো বৈয়াম ভেঙে গেছে। তখন আমার দোকান বন্ধ ছিল। ভয়ে আমি গলির ভেতরে এক দোকানে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলাম।’
শনির আখড়ার একটি হোটেলের মালিক বলেন, ‘এখন পরিস্থিতি শান্ত হলেও মানুষের মধ্যে ভয় রয়েছে। রাতে বিভিন্ন বাড়িতে অভিযান চালানো হচ্ছে। রাতে রাস্তায় গেলে অনেককে ধরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।’
উত্তর রায়েরবাগ কবরস্থান রোডের বায়তুল আমান (চানবানু) জামে মসজিদের পেশ ইমাম আজিজুর রহমান কাসেমী জুমার বয়ানে বলেন, ‘গতকালকে যাত্রাবাড়ীতে আমার একটা প্রোগ্রাম ছিল। আমি ভয়ে যাইনি। শুনছি অনেককে ধরে নিয়ে যাচ্ছে পুলিশ।’
শনির আখড়া ওভারপাস থেকে বাগানবাড়ি ঢালে নেমে কিছুটা এগোতেই হাতের বাম পাশে দোকান লাগোয়া একটা বিদ্যুতের ট্রান্সমিটার। ট্রান্সমিটারের পাশের দোকানটি বন্ধ। পাশের দোকানের সাটারসহ আশেপাশের এলাকাটায় কিছু কিছু জিনিসে তেল চিটচিটে ভাব। আশেপাশের দোকানদাররা জানিয়েছেন, গত রোববার পুলিশের গুলিতে এই ট্রান্সমিটারটি ফুটো হয়ে সব তেল বের হয়ে যায়। ওইদিন আশেপাশের অনেকেই রাস্তা থেকে সেই তেল সংগ্রহ করে নিয়েছেন। এই তেলে বাত-ব্যথা ‘নিরাময়’ হয় বলছেন অনেকে।
নিউজটি শেয়ার করুন